ভাষা যোগাযোগের একটি অন্যতম মাধ্যম। ভাষার মাধ্যমে আমরা আমাদের সুখ-দুঃখ, ভালো লাগা, খারাপ লাগা প্রকাশ করি। ভাষার যথাযথ ব্যবহার আমাদের সম্পর্কের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলতে পারে। এর সঠিক ব্যবহারে সম্পর্ক যেভাবে উপকৃত হতে পারে, তেমনি ভুল ব্যবহারে সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা তৈরি হতে পারে।
বড় বড় ঘটনা আমরা অনেক সময় মাফ করে দিতে পারি, এমনকি অনেক সময় ভুলেও যাই, কিন্তু দেখা গেছে কথার কষ্ট অনেক দিন ধরে আমাদের মনে থাকে। ফলে সম্পর্কের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়; আন্তরিকতা কমে যায়। সম্পর্কের ধরন অনুযায়ী ভাষার ব্যবহার ভিন্ন হতে পারে। যেমন একেকটি পরিবারের নিজস্ব ভাষাবোধ আছে, এতে পরিবারের সদস্যরা অনেক সময় অভ্যস্ত থাকে; কিন্তু এই একই ভাষা যখন আপনি অন্য কোনো সামাজিক পরিমণ্ডলে ব্যবহার করবেন—অফিস বা বন্ধু মহলে, তখন তা সমস্যা তৈরি করতে পারে। ইতিবাচক ভাষা ব্যবহারের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সম্পর্ক যতটা খারাপ হতে পারত, ততটা খারাপ হয়নি।
নেতিবাচক ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রচুর নেতিবাচক বিশেষণের ব্যবহার, যেমন অনেক খারাপ, দুর্বল, দুষ্টু, অসভ্য, লোভী, অলস, সুযোগসন্ধানী ইত্যাদি। আপনি লক্ষ করে দেখবেন, যখন কেউ আপনার সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ ধরনের নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করে, সেটা যেন আপনার মধ্যে যে ভালো ব্যাপারগুলো রয়েছে, তা অস্বীকার করে। যেমন আমরা যখন বলি, ও খুব লোভী, তখন আমরা সে যে অনেক সময় খাবার ভাগাভাগি করে সবাইকে দিয়ে খেয়েছে, সেটা পুরোটাই অস্বীকার করি। অথবা যখন বলি, ও খুব দুষ্টু ছেলে, তখন সে যে অনেক সময়ই মা–বাবার কথা মেনে চলেছে, তা যেন অস্বীকার করি।
ফরিদা বেগম বলছিলেন, কামাল সাহেবের সঙ্গে গত রাতে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়ে গেছে। আমার ২৫ বছরের বিবাহিত জীবন, কত কষ্ট করেছি আমি, কিন্তু গত রাতে ও এমন করে বলল যেন এই ২৫টি বছর আমি শুধু ওর অন্নই ধ্বংস করে গেছি, সংসারের জন্য কিছুই করিনি। অথচ ও নিজে খুবই অমিতব্যয়ী ও স্বেচ্ছাচারী। কখনো পরিবারের কথা ভাবে না। নিজের যা ভালো লাগে, তা–ই করে। মনে করল, এবার ঈদে দামি পোশাক কিনবে, সবার জন্য তাই কিনে আনল। অথচ এত টাকা খরচের কোনো দরকার ছিল না। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবে না।
তা ছাড়া ও অনেক লোভী, শুধু ভালো ভালো খাবার খাবে। প্রায়ই বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে আনবে, বলে, আমার রান্না মুখে দেওয়া যায় না। আমি কোনো গুণের নয়। এত খরচ করতে নিষেধ করলে বলে, আমি ছোটলোক, আত্মা বড় না। অথচ মাস শেষে আমাকেই আত্মীয়স্বজনের কাছে ধার চাইতে হয়। তখন কিন্তু ও কোনো দায়িত্ব নেয় না। এভাবেই চলেছে এতকাল। প্রায়ই এ নিয়ে ঝগড়া হয়, তবে প্রতিটি ঈদের আগে এ নিয়ে হুলুস্থুল লেগে যায়। প্রতিটি ঈদই আমার কান্না দিয়ে শুরু হয়। মন খারাপ থাকে। ও সবার জন্যই কেনে। আমার জন্যও কেনে। তবে আমি এমন চাই না। আমি চাই, ও আরও একটু মিতব্যয়ী হোক। কিন্তু ও কোনোভাবেই আমার কথা শুনবে না।
আপনার যে বন্ধু বিপদের সময় আপনার কাছ থেকে ধার নিয়েছিল, আর এখন আপনার বিপদে সাহায্য করতে পারছে না, তাকে স্বার্থপর না বলে বলা যায়, সে হয়তো আরও বড় কোনো বিপদে পড়েছে, তাই এখন সাহায্য করতে পারছে না। এতে ভবিষ্যতে সে আপনাকে হয়তো সাহায্য করবে—এই সম্ভাবনার পথ খোলা থাকে।
অন্যদিকে কামাল সাহেবের বক্তব্য হলো, ‘ফরিদা বেশ কৃপণ ও হিংসুটে। ও খরচ করতে চায় না। সারাক্ষণ ভবিষ্যৎ ভবিষ্যৎ করে। আত্মীয়স্বজনকে খাওয়াতে পছন্দ করে না, ঈদে-পার্বণে উপহার দিতেও পছন্দ করে না। এমন নয় যে সে নিজের জন্য অনেক খরচ করে, আসলে ওর আত্মাটাই অনেক ছোট। আরে, ভালো কিছু পেতে গেলে কিছু খরচ তো করতেই হবে। বর্তমানে যদি ভালো না থাকি, ভবিষ্যতে কীভাবে ভালো থাকব? আর সবাইকে নিয়ে ভালো থাকাটাই তো সত্যিকারের ভালো থাকা।’
এখানে ফরিদা বেগম যদি বলতে পারতেন, আমার স্বামী খুব শৌখিন মানুষ। খেতে খুব ভালোবাসেন। বাসায় তো সব সময় এমন খাবার রান্না হয় না, তাই রেস্টুরেন্ট থেকে প্রায়ই খাবার নিয়ে আসেন। তিনি আত্মীয়স্বজন সবাইকে নিয়ে ঈদ করতে চান, তাই প্রতিবারই সবার জন্য উপহার কেনেন। যদিও এগুলো আমাদের সাধ্যের অনেক বাইরে চলে যায়। আমাদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু রাখা কষ্ট হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে এগুলো নিয়ে আমি কিছু বললে তিনি মন খারাপ করেন।
অন্যদিকে কামাল সাহেবও যদি বলতেন, ‘ফরিদা ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক ভাবে, সঞ্চয় করতে চায়। তাই সে খাবার থেকে শুরু করে সবকিছুতেই মিতব্যয়ী হতে চায়। আসলে সংসার তো পরে ওকেই সামলাতে হয়। কিন্তু আমি ভাবি, আগে বর্তমান, তারপর ভবিষ্যৎ। এখন যেমন আছি চলতে থাকি, ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে।
উভয়ের প্রথম বক্তব্যে ঝগড়ার আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল; অথচ পরের বক্তব্যে সেটা ছিল না।
ভাষা শুধু মনের ভাবই প্রকাশ করে না, এটা আমাদের অনেক আবেগকে বাড়িয়েও দেয়। যখন কেউ আমাকে সৎ বলে, তখন সৎ শব্দটির সঙ্গে সম্পর্কিত যত আবেগ আছে, তা আমার মনের মধ্যে চলে আসে। একইভাবে যখন কেউ আমাকে হিংসুটে বলে, তখন এর সঙ্গে সম্পর্কিত সব আবেগও আমার মনে চলে আসে। অতীতে এ ধরনের কথা যদি আমি কখনো শুনে থাকি, তখনকার সেই কষ্ট আবার আমার মনের মধ্যে জেগে উঠবে। ফলে এটা বর্তমান সম্পর্কের মধ্যে নেতিবাচক ব্যাপার নিয়ে আসবে।
ভাষা শুধু মনের ভাবই প্রকাশ করে না, এটা আমাদের অনেক আবেগকে বাড়িয়েও দেয়।
ওপরের ঘটনায় ফরিদা বেগম কিন্তু তার ভাষা খারাপ করার মাধ্যমে কামাল সাহেবকে ওই কাজগুলো করা থেকে বিরত করতে তো পারেনইনি, বরং এর বিপরীতে অনেকগুলো নেতিবাচক কথা শুনেছেন। তেমনি কামাল সাহেব তার কথাগুলো বলার মাধ্যমে ফরিদা বেগমকে কিন্তু নিজের যুক্তি বোঝাতে পারেননি, মাঝখান থেকে সম্পর্কটা খারাপ হয়ে গেছে। পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধা এসেছে, পরস্পরের প্রতি পরস্পরের পছন্দের মাত্রা কমে গেছে, ভালোবাসাটাই উবে গেছে। আপনার মনে হতেই পারে, এভাবে না বললে তো শোনে না, নিজের কথা মানানো যায় না। তা ছাড়া নিজের পরিবারের মধ্যে আমি এত সতর্ক হয়ে থাকতে পারব না। এখানে যদি মন খুলে কথাই বলতে না পারলাম, তবে পরিবার মানেটা কী?
আমি আগেই বলেছি, একেকটি পরিবারে ভাষার ব্যবহার একেক রকম। যদি এভাবে বলার কারণে আপনাদের মধ্যকার সম্পর্ক ভালো থাকে, তবে হয়তো এখানে পরিবর্তনের দরকার নেই। কিন্তু যদি দেখা যায় সম্পর্ক সত্যিই খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তবে আমি বলব আমরা পরিবর্তনের কথা ভাবতে পারি। কারণ, আমরা শুধু আমাদের কথাটা মানাতে চাই না, আমরা এটাও চাই যে পরিবারের সদস্যরা আমাদের বিষয়টি বুঝবে, হাসিমুখে মেনে নেবে এবং সর্বোপরি আমরা চাই আমাদের পরিবারের মানুষগুলো আমাদের সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা পোষণ করবে। সম্পর্কের মধ্যে আমরা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা চাই। আবার এমনও তো হতে পারে, যদি সম্পর্ক ভালো থাকে, তবে আমার কথা বোঝানো ও মানানো অনেক সহজ হবে।
নেতিবাচক কথায় মানুষের নেতিবাচক আবেগ উঠে আসে। যেমন যখন আপনি আপনার ভাইকে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার কারণে অলস না বলে বলেন, সে ঘুমাতে খুব পছন্দ করে। এটা সহজেই অনুমেয় যে এ ধরনের কথা আপনাদের সম্পর্কের মধ্যে ততটা তিক্ততা নিয়ে আসবে না।
ধরুন, আপনার পরিবারের কোনো সদস্য এখনো প্রত্যাশা অনুযায়ী কোনো একটা কাজ করতে পারছে না, যেমন বাজার করা, রান্না করা, বিছানা গুছানো, সামাজিক পরিবেশে ভালোভাবে খাপ খাওয়ানো ইত্যাদি। আপনি ‘সে এটা পারে না’ না বলে বলতে পারেন, সে এখনো বিষয়টি শিখছে। আপনার যে বন্ধু বিপদের সময় আপনার কাছ থেকে ধার নিয়েছিল, আর এখন আপনার বিপদে সাহায্য করতে পারছে না, তাকে স্বার্থপর না বলে বলা যায়, সে হয়তো আরও বড় কোনো বিপদে পড়েছে, তাই এখন সাহায্য করতে পারছে না। এতে ভবিষ্যতে সে আপনাকে হয়তো সাহায্য করবে—এই সম্ভাবনার পথ খোলা থাকে।
সন্তান যখন মিথ্যা বলে, তখন যদি আমরা বলতে পারি, ‘তুমি আমাকে বোধ হয় আসল ব্যাপারটা খুলে বলছ না’; তখন আসল ব্যাপারটা বলার জন্য তার ভেতর একটা তাগিদ তৈরি হয় বা এটা বলার একটা সুযোগও থাকে। আর যদি বলি সে মিথ্যা বলছে, তবে মিথ্যাবাদী হিসেবে নিজের পরিচিতিটা তাকে আত্ম–অবমূল্যায়নই করে।
এভাবে ভাষা আমাদের সম্পর্ক শুধু ঠিকই রাখে না, ভাষা আমাদের নিজেকে শোধরানোর সুযোগও করে দেয়। নেতিবাচক ভাষা ব্যক্তি সম্পর্কে একটা দাড়ি টেনে দেয়, একটা উপসংহার টেনে দেয়। ফলে ব্যক্তির পরিবর্তনের জায়গাটা বন্ধ হয়ে যায়, তার ভেতরের তাগিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বোপরি সম্পর্কটা খারাপ করে দেয়। তাই চলুন, ভাষার যথাযথ ব্যবহার আমরা পরিবার থেকেই শুরু করি এবং সম্পর্কের মধ্যে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসি।
লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, শামসুন্নাহার হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল