আমি ডাক্তার নই, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞও নই। বাংলাদেশের একজন অতি সাধারণ নাগরিক হিসেবে কভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আমার প্রতিক্রিয়া ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন, উপ-সম্পাদকীয়, টক-শো দেখে কভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা জন্মেছে। এর বাইরে কভিড আক্রান্ত বন্ধু-বান্ধব বা সহকর্মী কিংবা তাদের পরিচিতজনের অভিজ্ঞতাই আমার জ্ঞানের ভিত্তি।
প্রথমেই বলে নিতে চাই যে, দেশে করোনার যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে তা মানসম্মত। অর্থাৎ সম্মানিত চিকিৎসকরা এ বিষয়ে সম্যক জ্ঞান রাখেন। চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য শুনিনি। প্রত্যেক রোগীর জন্য আলাদা আলাদা ওষুধপত্র দেওয়ার প্রয়োজন আছে। বুঝেছি যে, উপসর্গ ধরে ধরে তারা চিকিৎসা করেন। ফুসফুস মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হলে, রোগীর অবস্থা দ্রুত অবনতি হতে পারে। তখন বোধকরি যথেষ্ট মাত্রায় অক্সিজেন দিতে হয়।
অনেক বিজ্ঞ চিকিৎসক টেলিভিশন ও খবরের কাগজের মাধ্যমে নিয়মিত সতর্কবার্তা প্রচার করছেন। সরকারও একই সঙ্গে কভিডের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে। জীবন-জীবিকাকে যতটা সম্ভব চলমান রাখা যায় সেই লক্ষ্যে শিল্প-কারখানা বিশেষ করে পোশাক শিল্প-কারখানা খোলা রাখার বিকল্প নেই। এ কারণে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিলেও কারফিউর মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উন্নত বিশ্বের বহু দেশে কারফিউ জারি করে জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সাবধানতার কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার করা এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। এত কথা এ কারণে বললাম, যে তিনটি বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে সে তিনটি বিষয়ে পালন করা মোটেই কষ্টের কাজ নয়।
টিকা প্রদানের কাজ চলছে, আমি সিএমএইচে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছি। দু’বারই অতি চমৎকার ব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করেছি। বন্ধু-বান্ধব যারা অন্য হাতপাতলে টিকা নিয়েছেন তাদের মুখে শুনেছি, তাদের অভিজ্ঞতাও অত্যন্ত ভালো। অর্থাৎ রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে সীমাবদ্ধতা থাকার পরও সরকার যথাসম্ভব সাধ্যমতো সার্বিকভাবে সুচিকিৎসার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কাজেই চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করার ক্ষেত্রে প্রকৃতভাবে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। বিমানবন্দর থেকে চিকিৎসা সামগ্রী ও ওষুধপত্র সংশ্নিষ্ট অধিদপ্তরের হাত ঘুরে হাসপাতালে পৌঁছাতে যেন বছরখানেক না লাগে।
আমার দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয়, ওষুধের প্রাপ্যতা। সোমবারই খবরে দেখলাম, ভারত থেকে বাংলাদেশের কাছে রেমডেসিভির নামক ইনজেকশনটি চাওয়া হতে পারে। এটি একটি ব্যয়বহুল ওষুধ। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য কোম্পানি এই ওষুধটি তৈরি করছে। এই ওষুধটি ভারতও তৈরি করে পর্যাপ্ত সংখ্যায়। রোগের বিস্তার কতটা হবে, তা ধারণা করা কষ্টের। এই বিবেচনায় ভারত এই ইনজেকশনটি অন্য দেশে রপ্তানি বন্ধ করেছিল। এখন তাদের কিছু রাজ্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা নিরূপণ করে অতিরিক্ত পাওয়া গেলে তবেই ভারতকে দেওয়া যেতে পারে।
কভিডের টিকার বিষয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ একই ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় টিকা পাঠানো হচ্ছিল ইতালি হয়ে। ইতালি সরকার আটকে দিয়েছিল। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা কিনছে বাংলাদেশ। মূল্যও পরিশোধ করা হয়েছে। বেসরকারি কোম্পানি বেক্সিমকো এ ব্যাপারে সমন্বয় করছে। কিন্তু এখন উৎপাদনকারী কোম্পানিটি প্রয়োজনীয় টিকা সরবরাহ করতে পারছে না। কারণ ভারত সরকার টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। ওই কোম্পানি বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। একাই বিশ্বের প্রয়োজনে বিভিন্ন রোগ প্রতিষেধকের টিকার ৬০ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে। এ রকম কোম্পানির টিকা রপ্তানি বন্ধ করার ফলে বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর অনেক দেশ ঝামেলায় পড়েছে।
টিকা সরবরাহ বিষয়ে ভারতের আরেকটি পদক্ষেপ দেখা দরকার। তারা যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত একটি কোম্পানির টিকা এবং রাশিয়ায় উদ্ভাবিত টিকা আমদানি করার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ নিজেদের উৎপাদনের ক্ষমতা থাকার পরও ওষুধ ও চিকিৎসা বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তারা নিরাপদ করতে চাইছে। তারা রেমডেসিভির ওধুষটির কেবল রপ্তানিই বন্ধ করেনি, একই সঙ্গে ওষুধটি তৈরির উপাদানও রপ্তানি বন্ধ করেছে। আমি এটাতে অন্যায়ের কিছু দেখি না। দীর্ঘ যাত্রায় বিমানে উঠলে নিরাপত্তাবিষয়ক বিমানবালা যে পরামর্শগুলো দিয়ে থাকেন তার একটি হচ্ছে, কোনো কারণে অক্সিজেন দরকার হলে অক্সিজেন মাস্ক নেমে আসবে এবং যাত্রী যেন প্রথমে নিজের নাকে মাস্ক লাগিয়ে নেন; পরে পাশের যাত্রীকে প্রয়োজনমতো সাহায্য করেন। অর্থাৎ কভিড মোকাবিলায় যেসব ওষুধ এবং যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হতে পারে যেমন অক্সিজেন সিলিন্ডার, হাই ফ্লো ক্যানোলা, টিকা ইত্যাদি সরবরাহ সুনিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। চিকিৎসা বিষয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের পূর্ভাবাস গ্রহণ করে সাবধানতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমার তৃতীয় বিষয় কভিড মোকাবিলায় নিজস্ব গবেষণা। সংবাদমাধ্যমে পড়েছি দু’ধরনের গবেষণায় আমরা এগিয়েছিলাম। প্রথমত, কভিড আমাকে আক্রমণ করেছে কি? এর দুটি পদ্ধতি আছে। প্রথমটি, শরীর থেকে স্যাম্পল নিয়ে সেখানে ভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষা করা, এটা একটু ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশ কাজ করছে। অন্যটি হচ্ছে, এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা পরীক্ষা করানো। এটি তত ব্যয়বহুল নয় এবং ততটা সময়সাপেক্ষ নয় বলে জেনেছি। প্রথম পদ্ধতিটির তুলনায় এটি ততটা নির্ভুল নয়। তবুও এই পদ্ধতিতে প্রাথমিক পরীক্ষা করা যেতে পারে। এই পদ্ধতির ভিত্তিতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একজন গবেষক উপযুক্ত পদ্ধতি প্রস্তুত করেছিলেন। আমাদের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এটিকে পাত্তা দিতে চাননি। কেন? এটি কি দেশীয় বিশেষজ্ঞের তৈরি? এটি কি দেশীয় গবেষণার ফল? এখন খবরের কাগজে পড়েছি, কোরিয়া থেকে সেই পদ্ধতিটি কেনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে দুই ধরনের টিকা আবিস্কার করা হয়েছিল। ওই টিকা গ্রহণযোগ্য হতে পারে বলে মনে করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই টিকা মানুষের ব্যবহারের জন্য আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন ছিল বলে জেনেছি। এই গবেষকদের দেশের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উৎসাহ দেওয়ার কথা শুনিনি। বরং নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বললে ভুল হবে না। প্রশ্ন হলো, টিকা আবিস্কার এবং রোগী নির্ণয়- দুই কাজেই দেশীয় উদ্যোগ আমরা উৎসাহিত করলাম না কেন? আমরা আর কতকাল হীনমন্যতায় ভুগব? আমি নিজের বিষয়ে বিশ্বের যে কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে একই প্ল্যাটফর্মে অবস্থান করি। কিন্তু নিজের দেশে দেখেছি, বিদেশি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নীতিনির্ধারকের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। দেশীয় বিশেষজ্ঞদের বরং ঠেলে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আগামী দুই-চার মাসের মধ্যে করোনা বিদায় নেবে না- এ কথা নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে। ধারণা দেওয়া হচ্ছে, ভাইরাসটি থেকেই যাবে। অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ধরে প্রতি বছর করোনা টিকা নিতে হতে পারে। কাজেই আমদানিনির্ভর ব্যবস্থাপনাকে যত শিগগির সম্ভব পরিহার করে দেশজ পদ্ধতি গ্রহণ করার কথা ভাবা শুরু করা উচিত।
আমার আলোচনার চতুর্থ বিষয়- কভিড মোকাবিলায় প্রস্তুতি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে। পাশের দেশ ভারতেও একই অবস্থা। প্রথম ঢেউ থেকে দ্বিতীয় ঢেউ আরও মারাত্মক। ইউরোপের দেশগুলোয় তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে এবং ভাইরাসটি তার ধরন বদলাচ্ছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত রোগীর অক্সিজেন বেশি লাগছে। কভিড প্রস্তুতিতে ধারাবাহিভাবে সক্ষমতা উন্নত করতে হবে। হয়তো অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কভিড মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি টিকা আবিস্কৃত হবে। আমরা বসন্ত, কলেরা, কুষ্ঠ এবং যক্ষ্ণা রোগের টিকা ও সহজ চিকিৎসা চালু হতে দেখেছি। ডায়রিয়াবিষয়ক চিকিৎসা বাংলাদেশে উদ্ভাবিত হয়েছে এবং বিশ্বদরবারে নিয়ে গেছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, এখন থেকে কভিডের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনার চিন্তা শুরু করতে হবে। আমরা এখন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবছি। এটা অতি প্রয়োজনীয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা-ভাবনা এবং প্রস্তুতির জন্য দেশীয় গবেষকদের উৎসাহিত করার বিকল্প নেই।
পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; ইমেরিটাস
অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়