বৈশ্বিক কোভিড-১৯ মহামারির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানে। এই অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে পরবর্তী কয়েক যুগ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। করপোরেট ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ভয়াবহ এ মহামারি প্রভাব ফেলেছে ব্যক্তিপর্যায়েও।
তবে করোনাকালীন সময়ে আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে ই-কমার্সে। লকডাউন ও নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষার্থে দেশের অনেক মানুষ বর্তমানে অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটা করেন, যার প্রচলন করোনার আগে এতটা ছিল না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে সাফল্যের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তা। অনলাইনে এখন বস্ত্র, গয়না, সাংসারিক পণ্য, শিশুখাদ্য, প্রসাধন সামগ্রী থেকে শুরু করে শিক্ষণীয় বিষয়গুলোও যুক্ত হয়েছে।
দরিদ্রতা, পারিবারিক জটিলতা, নিজেদের স্বাবলম্বী করে তোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে দেশে নারীরা সংকীর্ণতার শেকল খুলে নিজেদের সমাজে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। বিশেষ করে, শিক্ষার্থীরা লকডাউনে অবসরকে কাজে লাগিয়ে এরকম কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। এমনকি অনেক প্রতিবন্ধী নারী ও শিশু বাড়িতে বসে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হয়ে সফলতা অর্জন করছে। কত টাকা পুঁজি আছে বা কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে তা নয়, বরং একজন উদ্যোক্তার বড় মূলধন তার নতুন কিছু করতে চাওয়ার ইচ্ছা। সদিচ্ছা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সৃজনশীল কর্মের সর্বোত্তম প্রয়োগের মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাধা পেরিয়ে নারীরা সমাজে মর্যাদার স্থানে প্রতিষ্ঠিত হতে সর্বদা সচেষ্ট। ভেনচার ক্যাপিটাল রিসার্চ ডাটাবেজ পিচবুক থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যানের মতে বাংলাদেশে মোট উদ্যোক্তার শতকরা প্রায় ৬০ ভাগই নারী এবং নারী উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
তবে নারীদের এই সফলতার গল্পটি এতটাও সহজ ছিল না। নিজেদের আবিষ্কার করতে এখনো অনেক নারীকে প্রতিনিয়ত সমাজ ও বাস্তবতার সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেকটি নারীই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত। শুধু আর্থিক নয় মানসিকভাবেও তারা নিপীড়িত। অথচ গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ নারীর মধ্যেই কিছু না কিছু করার আগ্রহ আছে। কিন্তু পারিবারিক সহযোগিতা বা অর্থাভাবে বেশির ভাগেরই এই চাওয়া পূরণ হয়ে ওঠে না। প্রত্যেকটি নারী যদি নিজেদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ পেত, তাহলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আরো স্বাবলম্বী হতে পারত। গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় বাধা স্থানীয় সংস্কৃতি, গ্রামাঞ্চলের কুসংস্কার এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। সময়ের পরিক্রমায় নারীদের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাংকের নিয়মনীতিতে শিথিলতা আনতে হবে। সরকারি ব্যাংকগুলো এজন্য বিশেষ নির্দেশনা জারি করতে পারে। এছাড়া ট্রেড লাইসেন্স পেতেও উদ্যোক্তাদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। সরকারি-বেসরকারি এনজিগুলো যদি গ্রাম ও শহরকেন্দ্রিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, তাহলে নারীরা আরো দক্ষতার সঙ্গে এগোতে পারবে। যারা অনলাইনকেন্দ্রিক ব্যবসা করেন তাদের পণ্যের গুণমান অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
নারীরা নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পেরেছে। চ্যালেঞ্জিং হলেও নারীরা দেখিয়ে দিয়েছে মেধা ও পরিশ্রমে সবকিছু অর্জন করা যায়। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও পারিবারিক সহযোগিতাই পারে নারীকে আরো এগিয়ে দিতে। আমাদের প্রত্যেককেই নারী ও নারীর কাজকে মূল্যায়ন করতে হবে। নিজ নিজ জায়গা থেকে নারীদের ছোট বড় সব কাজে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।