বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় টিকা অভিযান চলছে। বিশ্বে ইতিমধ্যেই ৪৪৩ কোটি টিকা দেওয়া শেষ হয়েছে। বলা হচ্ছে, টিকা আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যু রোধে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে। আর মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ টিকা দিলে তৈরি হবে হার্ড ইমিউনিটি। তখন জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে দেশগুলো। আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন ট্র্যাকারগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, এখন প্রতিদিন যে গতিতে বিশ্বে টিকা দেওয়া হচ্ছে তাতে মোট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ টিকা দিতে আরও ৫ মাস সময় লাগবে। তবে উন্নত বিশ্বের এই টিকা দানের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না অনুন্নত ও উন্নয়শীল দেশগুলো। আশার বিষয় হলো বিশ্বে ক্রমাগতই টিকা উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নতুন নতুন কোম্পানির নতুন ভ্যাকসিন বাজারে আসছে।
ব্লুমবার্গ ভ্যাকসিন ট্র্যাকারের তথ্যানুসারে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী টিকা দেওয়ার হার প্রতিদিন গড়ে ৪ কোটি ২৬ লাখ ৫০৩ ডোজ। সংখ্যার হিসাবে এখন প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি এক কোটি ৭১ লাখের বেশি ডোজ টিকা দিচ্ছে চীন। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারত প্রতিদিন ৫৫ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি ডোজ টিকা দিচ্ছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রতিদিন ২২ লাখ ৬৯ হাজার টিকা দিচ্ছে জাপান। চতুর্থ অবস্থানে থাকা ব্রাজিল ১৪ লাখ ২৬ হাজার টিকা দিচ্ছে ব্রাজিল। পঞ্চম অবস্থানে থাকা পাকিস্তান প্রতিদিন ৯ লাখ ৫৪ হাজার ডোজ টিকা প্রয়োগ করছে। ষষ্ঠ অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া প্রতিদিন ৭ লাখ ৮৩ হাজার ডোজ টিকা প্রয়োগ করছে। ৭ম অবস্থানে থাকা মেক্সিকো প্রতিদিন ৭ লাখ ৩৯ হাজার ডোজ টিকা দিচ্ছে। ৮ম অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন ৭ লাখ ১২ হাজার টিকা প্রয়োগ করছে। অবশ্য ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮ শতাংশের বেশি মানুষকে অন্তত এক ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে নবম অবস্থানে থাকা মালয়েশিয়া প্রতিদিন ৬ লাখ ৫০ হাজার জনগণকে টিকা দিচ্ছে। দশম অবস্থানে থাকা রাশিয়া প্রতিদিন টিকা দিচ্ছে ৫ লাখ ৭৯ হাজারের বেশি। প্রায় সমসংখ্যক ৫ লাখ ১৭ হাজারের টিকা প্রতিদিন দিচ্ছে ফ্রান্স। অবশ্য ফ্রান্স ইতিমধ্যেই ৬৮ শতাংশ জনগণকে টিকার আওতায় নিয়ে ফেলেছে। প্রতিদিন ৪ লাখের বেশি টিকা প্রয়োগ করছে কলম্বিয়া, ফিলিপাইন্স, সৌদি আরব, ইতালি ও থাইল্যান্ড। প্রতিদিন ৩ লাখের বেশি টিকা দিচ্ছে তুরস্ক, জার্মানি, স্পেন, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, শ্রীলঙ্কা, মরক্কো, উজবেকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়া। জাপানের নিক্কি এশিয়ান রিভিউ ট্র্যাকারের ভ্যাকসিন ম্যাপ অনুসারে, প্রতিদিনে গড় টিকা দেওয়ার পরিমাপের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসাবে চিলির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে আগামী এক মাসের মধ্যে অর্থাৎ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে, আগামী দুই মাসের মধ্যে অর্থাৎ ২০২১ সালের অক্টোবরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল ও জার্মানির, পাঁচ মাসের মধ্যে অর্থাৎ ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনা টিকা নিয়ে গোটা বিশ্বে এখন আপাতত দুটি চিত্র দেখা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলোতে করোনা টিকা এখন সহজলভ্য। এসব দেশের অধিকাংশ নাগরিক টিকার দুই ডোজ নিয়ে ফেলেছেন এবং নিজেদের আপাতত নিরাপদ ভাবতেও শুরু করেছেন। তাদের অনেকের ভাবনা এই করোনার সমস্যা আপাতত আর তাদের নেই। এটা এখন কেবল অন্যদের সমস্যা! অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো এখনো করোনা টিকা পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করছে। বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক গুণ বেশি অর্থ খরচ করতেও প্রস্তুত তারা। কিন্তু তাও করোনা টিকা পাওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা মিলছে না। কূটনৈতিক চেষ্টাও জোরদার করেছে এসব দেশ টিকা পাওয়ার আশায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসাস বলেছেন, অনেক দেশ যেখানে টিকা দেওয়া শুরুই করেনি, আর সেখানে কিছু দেশ তাদের জনসংখ্যার সিংহভাগকে দুই ডোজ টিকা দিয়ে ফেলেছে। এখন তারা বুস্টার হিসেবে তৃতীয় ডোজ দেওয়ার পথে। আমরা বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে যে ভাগাভাগির কথা বলি, সেটা বিনামূল্যে নয়। অধিকাংশ দেশ টিকার দাম দিতে সক্ষম কিন্তু তাদের কাছে টিকা নেই। আমরা বিশ্বাস করি দ্রুত টিকা উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষমতা বিশ্বের রয়েছে। করোনা টিকা উৎপাদন এবং বিলিবণ্টন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টিকা উৎপাদনের অধিকাংশ মালিকানা যাদের রয়েছে, তারা উৎপাদন বাড়াতে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। তাহলে তা অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে। সবাই জানে সামর্থ্যটা কাদের আছে। এটা সেসব দেশে আছে যাদের সামর্থ্য আছে, যাদের উৎপাদন সক্ষমতা আছে, যাদের অর্থনৈতিক শক্তি আছে। এটা দ্বিস্তরের ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা প্রধান বলেছেন, উচ্চ আয়ের যে দেশগুলো তাদের জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশকে টিকা দিচ্ছে, তারা কভিড-১৯ মহামারীকে নিজেদের সমস্যা বলে মনে করছে না। এটা বিপজ্জনক।বাংলাদেশের অবস্থান : স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে ১১ কোটি ৭৮ লাখ ৫৬ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই ১ কোটি ৩১ লাখ ৫৯ হাজারের বেশি মানুষকে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ৪৫ লাখ ১৯ হাজারের বেশি মানুষকে। তবে আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন ট্র্যাকারগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো নিচের দিকে। উপমহাদেশের ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা তালিকার উপরের দিকে অবস্থান করলেও বাংলাদেশের অবস্থান উল্লেখযোগ্য নয়। প্রতিদিনের টিকা দেওয়ার গড়ে বাংলাদেশ ২ লাখের বেশি টিকা দিলেও প্রতি একশ জনের টিকা দেওয়ার হার ও মোট জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়ার হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিচে রয়েছে শুধু আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলো।