বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের একটি শরিক দল বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল। ‘নামসর্বস্ব’ এ দলটি একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর প্রায় বিলীনের পথে। দলটির প্রধান আবু সাঈদ সপরিবারে কানাডায় চলে গেছেন। তার দেশে ফেরার সম্ভাবনাও কম। করোনাকালে হারিয়ে গেছে জোটের আরেকটি শরিক দল ডেমোক্র্যাটিক লীগ (ডিএল)। ২০-দলীয় জোটের কোনো বিবৃতি থাকলে সেখানে শুধু সংগঠনটির নাম খুঁজে পাওয়া যায়। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মণি জানালেন, ‘শুধু আমরা কেন, কোনো দলেরই তো কার্যক্রম নেই। আর এ ধরনের একটি স্বৈরাচার সরকার থাকলে কোনো দল চলতে পারে না।’
শুধু সাম্যবাদী দল বা ডিএলই নয়, দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলেরই বেহাল অবস্থা। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, গুটিকয়েক বাম দল ছাড়া অধিকাংশেরই অস্তিত্ব সংকটে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে গড়ে ওঠা জোটবদ্ধ দলগুলো এখন আর খুঁজ পাওয়া যায় না। বিশেষ করে দেড় বছর ধরে করোনা চলাকালে ‘বড় ধাক্কা’ লেগেছে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলে। এসব দলের এমনিতেই লোকবল নেই, এক ব্যক্তির এক দল-এর মধ্যে করোনা সংকটে লেজেগোবরে অবস্থা।এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব বদিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে এখন কোনো রাজনীতিই নেই, রাজনৈতিক দলও নেই। বড় দলগুলোর মধ্যেও নেই রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। তারাও পরিবার ও ব্যক্তিতান্ত্রিক। আর ছোট দলগুলোতে ফুটবল খেলার জন্য যত সদস্য লাগে তাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘নামসর্বস্ব’ দলগুলো এক ব্যক্তির এক দল। এগুলো ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার জন্য দল করে। তারা মানুষের কল্যাণে নয়। সুতরাং তাদের কাছে জাতিও কিছু আশা করে না।’
ওয়ান-ইলেভেনে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল। ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর নেতৃত্বে এ দলটি গড়ে ওঠে। কিছু দিন আগে ড. কোরেশী মারা যান। তার রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনও বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। এ দলটির এখন নেই কোনো কার্যক্রম। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম ও বাংলাদেশ কংগ্রেস নামে তিনটি রাজনৈতিক দল আছে। এগুলো এক ব্যক্তির দলে পরিণত হয়েছে। করোনাকালে এদের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে অবশ্য গণমাধ্যমে এসব রাজনৈতিক দল বিবৃতি পাঠায়।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা কে, এর অফিস কোথায়- তাও জানে না সাধারণ মানুষ। একই অবস্থা জাগো বাঙালি, ইউনাইটেড মাইনোরিটি পার্টি, সম্মিলিত নাগরিক পার্টি (ইউসিপি), বাংলাদেশ ইনসাফ পার্টি, দেশপ্রেমিক নাগরিক পার্টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক পার্টি (বিকেএসপি), স্বাধীন পার্টি (এসপি), বাংলাদেশ প্রগতিবাদী জনতা পার্টি (বিপিজেপি), বাংলাদেশ পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টিরও। এগুলো নামেই রাজনৈতিক দল। বাস্তবে এদের নেই কোনো কর্মকান্ড। ভোট এলেই এরা কোনো জোটে যাওয়ার জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালায়। শুধু চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মিলাতেই এসব দল গড়ে ওঠে।
নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের তালিকাভুক্ত দলগুলো হলো-লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, জাতীয় পার্টি-জেপি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম এল), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, জাকের পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল পিপলস্? পার্টি (এনপিপি), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম ও বাংলাদেশ কংগ্রেস।
উল্লেখযোগ্য অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে রয়েছে- গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ ফ্রীডম পার্টি, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) (উমর), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (সাঈদ), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), ন্যাপ ভাসানী, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, আমার বাংলাদেশ পার্টি, আঞ্চলিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এর বাইরেও বেশ কিছু নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। যাদের অস্তিত্ব এখন বিলীন হয়ে গেছে। এসব দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন-যুক্তফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোট ও গণঐক্য নামে নানা জোটে সম্পৃক্ত। জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি (বিএমপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে ২৯টি দল নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ) নামের নতুন একটি রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ভোটের পর এসব দল হারিয়ে যায়। তাদের নেই কোনো কার্যক্রম। করোনাকালে মানুষের পাশে নেই এসব দল। নাম ও প্যাডসর্বস্ব এসব দলের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি (বিএমপি), বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (বিএলডিপি), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, জাগো বাঙালি, ইউনাইটেড মাইনোরিটি পার্টি, সম্মিলিত নাগরিক পার্টি (ইউসিপি), বাংলাদেশ ইনসাফ পার্টি, দেশপ্রেমিক নাগরিক পার্টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক পার্টি (বিকেএসপি), স্বাধীন পার্টি (এসপি), বাংলাদেশ প্রগতিবাদী জনতা পার্টি (বিপিজেপি), বাংলাদেশ পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (বিপিডিপি), গণতান্ত্রিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, গণতান্ত্রিক ন্যাপ, বাংলাদেশ মাইনোরিটি ইউনাইটেড ফ্রন্ট, ন্যাশনাল লেবার পার্টি (এনএলপি), বাংলাদেশ সচেতন হিন্দু পরিষদ, বাংলাদেশ তফসিল ফেডারেশন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলন, গণসংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ গণশক্তি পার্টি (বিজেএসপি), বাংলাদেশ দুনিয়া দল, বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি (বিআরপি) ও বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। এর মধ্যে কয়েকটি দল যোগ দেয় যুক্তফ্রন্টে। দু-একটি বাদে সবই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনহীন। এ প্রসঙ্গে বিএনএ চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে জোট হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সবাই নিজেদের মতো করে দল চালাচ্ছে। আমার তৃণমূল দলেরও নিবন্ধন নেই। তাই এখন আমরা নিজেদের দল গোছানো নিয়েই ব্যস্ত। দলকে শক্তিশালী করে নিবন্ধন করা হবে। এরপর প্রয়োজন হলে আবার জোটকে সক্রিয় করা হবে। নইলে এভাবেই চলব।’ জানা যায়, জাতীয় নির্বাচনের আগে বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ১১টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। পরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য গড়ে জোটটি। নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে মাহী বি চৌধুরী ও তার দলের মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নান। এরপর আর জোটের কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়নি। দলগুলোও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। দলগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিএলডিপি, বাংলাদেশ ন্যাপ, এনডিপি, জাতীয় জনতা পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, গণসাংস্কৃতিক দল, বাংলাদেশ জনতা লীগ, বাংলাদেশ শরিয়া আন্দোলন, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ মাইনোরিটি ইউনাইটেড ফ্রন্ট। দলগুলোর মধ্যে বিকল্পধারা, ন্যাপ ও গণফ্রন্ট নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত।
একইভাবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে অর্ধশত নামসর্বস্ব দল নিয়ে একটি জোট গড়ে উঠেছিল। জাতীয় নির্বাচনের পর এরশাদের দল জাতীয় পার্টি ছাড়া বাকিগুলো হারিয়ে গেছে। একইভাবে ওই সময় গজিয়ে ওঠে বেশ কয়েকটি নামসর্বস্ব বাম দলও।