বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ২০২০ সলের ৮ মার্চ। এ পর্যন্ত দেশে মোট মৃত্যু ১৯ হাজার ছাড়িয়েছে। মোট শনাক্ত প্রায় ১২ লাখ। শনাক্তের হার ২৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ, যা শুধু সর্বোচ্চই নয় বরং সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনো দেশে করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ বা তার বেশি হলে তা সরকারের ব্যবস্থাপনাগত আয়ত্বের বাইরে চলে যায়।
২৭ জুলাই আমাদের দেশে করোনা শনাক্তের হার ছিল ২৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শুধুমাত্র সরকারের আয়ত্বের বাইরেই নয় অনেক দূরে অবস্থান করার কথা। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অসীম রহমত এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নের্তৃত্ব করোনা মোকাবিলায় অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে।
এ দেশে বিদ্যামান যেকোনো খাতের তুলনায় স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা খুবই সঙ্গিন, বরাদ্দের পরিমান তুলনামূলক বিচারে খুবই কম, যা দীর্ঘদিন থেকেই হয়ে আসছে। এ অবস্থা শুধু যে আমাদের দেশে তা নয়, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই স্বাস্থ্যখাত উপেক্ষিত, যা মহামারিকালে অত্যন্ত নগ্নভাবে দেখা গেছে। এ অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত আগ্রহ, প্রচেষ্টা, দৃঢ়তা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে মহামারিকালে ব্যবস্থাপনাগত অবস্থা সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। সীমিত সামর্থ্যের মধ্য থেকে ইতিমধ্যে সরকার যে সকল কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে, তা শুধু দেশেই নয় আন্তর্জাতিক মহলেও গ্রহণযোগ্য ও সমাদৃত হয়েছে। মহামারিকালে দরিদ্র জনগণের জন্য খাদ্য সরবরাহ, চিকিৎসার সঙ্গে ডাক্তারদের সম্পৃক্ততা, চিকিৎসা উপকরণ ক্রয়, টিকা ক্রয় ও এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু অব্যবস্থাপনা বাদ দিলে বর্তমানে সরকার একটি যৌক্তিক অবস্থানে রয়েছে, যা প্রসংশার দাবি রাখে।
উন্নত দেশগুলোর মধ্যে একটি হলো অস্ট্রেলিয়া, যেখানে সরকার লকডাউন দিয়ে, সীমান্ত বন্ধ করে, কারফিউ দিয়ে, ফ্লাইট বন্ধ রেখে, জেল জরিমানার বিধানসহ ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়ে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখিয়েছেন। কিন্তু টিকা সংগ্রহ ও প্রয়োগে এখন পর্যন্ত তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে নেই।
মহামারি বিশ্লেষকদের মতে, সংক্রমণের হার কমাতে লকডাউন ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকা দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। উন্নত দেশ হলেও সেখানে টিকা বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠার কারণে তারা টিকা ক্রয় ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে এখনো আমাদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া টিকা সংগ্রহ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে সরকারের যে পরিকল্পনা ও অগ্রগতি তাতে জুলাই ২০২২ নাগাদ মোট জনসংখ্যার ৭০-৮০ ভাগ টিকার আওতায় আসবে এবং অনেক উন্নত দেশের তুলনায় আমরা এগিয়ে যাবো।
অপরদিকে, সার্বিক ও এলাকাভিত্তিক লকডাউন, প্রণোদনা প্যাকেজ, সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবে ভীতসন্ত্রস্ত চিকিৎসক ও নার্সদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী টিকার প্রাপ্তি ও এর প্রয়োগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে শেখ হাসিনার সরকার এখন একটি সূনির্দিষ্ট গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত সময়োপযোগী।
এবার করোনাকালে মানবতার সেবায় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে নজর দেওয়া যাক। করোনাকালে সরকারের পাশাপাশি সকল শ্রেণি পেশার মানুষই নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে আমরাও ব্যতিক্রম নই, শুরু থেকেই এগিয়ে এসেছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবি, ডাক্তার, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। যারা তাদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে দাঁড়িয়েছেন মানবতার পাশে, যা দেশবাসী খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, মহামারিকালে প্রত্যাশিত অনেককেই দেখতে পাওয়া যায়নি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে। যেমন দেখতে পাইনি আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। তিনি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এবং সামর্থ্যবান এমন একজন ব্যক্তি যার আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি রয়েছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। নিজ সামর্থ্যের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি বড় ফান্ড জোগাড় করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবেন-এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা ছিল। এ ছাড়া মহামারি সময়ে তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে কিভাবে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়, সে চেষ্টা করবেন এটাই সাধারণ মানুষ আশা করেন।
এসব ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের কোনো উপস্থিতি কোথাও আমরা দেখতে পাই না, নাকি আমাদের চোখেরই সমস্যা! অথচ আমরা অনেকেই সেই মহামানবের দিকে তাঁকিয়ে থাকি। কারণ তিনি শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পেয়ে আমাদের শুধু ধন্যই করেননি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বৃদ্ধি করেছেন আমাদের মান ও মর্যাদা! তাই দেশবাসীর কাছে বিনীতভাবে প্রশ্ন রাখতে চাই, এই নোবেল বিজয়ীকে দিয়ে দেশের আপামর জনসাধারণের কী কী কল্যাণ সাধিত হয়েছে বা হবে? করোনাকালে তথাকথিত নোবেল বিজয়ীর যদি সর্বজনগ্রাহ্য কোনো ভূমিকাই না থাকে তাহলে এ নোবেল প্রাইজ ধুয়ে কি দেশের মানুষ পানি খাবে? তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এ নোবেল কার স্বার্থে? দেশের স্বার্থে নাকি ব্যক্তি স্বার্থে, নাকি আন্তর্জাতিক মহলের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে?
এ বছর অলিম্পিক আসরে ড. ইউনূসকে অলিম্পিক সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছে (২৩ জুলাই ২০২১ সূত্র: আইওসি)। সেখানে বলা হয়েছে ‘ক্রীড়া উন্নয়নে তাঁর বিস্তৃত কাজ’-এর জন্য তাকে এ সম্মাননা দেওয়া হলো। আইওসি আরও জানিয়েছেন, ক্রীড়া কার্যক্রমের মাধ্যমে সংস্কৃতি, শিক্ষা, শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের স্বীকৃতি স্বরুপ ৫ বছর আগে প্রথম সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল কেনিয়ার সাবেক তারকা কিপ কেইনোকে। তিনি নিজ দেশে একটি শিশু নিবাস, একটি স্কুল ও অ্যাথলেটদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের অনুশীলন কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। আর এবার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ সম্মাননা তুলে দেওয়া হলো আমাদের মান্যবর ড. ইউনূসকে!
এ ক্ষেত্রে দেশে বা বিদেশে ক্রীড়াক্ষেত্রে এমন কি অবদান তিনি রেখেছেন, যার ফলে আইওসি কর্তৃক উল্লিখিত লক্ষ্য অর্জন করলেন? এবারও কি আগের মতোই সম্মাননা অর্জনে সক্ষমতা দেখালেন? তাই প্রশ্ন জাগে এ সম্মামনা তার শান্তিতে নোবেল বিজয়ের মতো আমাদের কি অমরত্ব এনে দেবে? আসলে অর্জন তখনই স্বার্থক হয় যখন তা সাধারণ মানুষের কোনো না কোনো উপকারে লাগে, অন্যথা নয়। পরিশেষে আমি ড. ইউনূসের দীর্ঘজীবন ও কর্মক্ষেত্রে আমৃত্যু সফলতা কামনা করি।
ড. মো. কামরুজ্জামান : অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়