বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ কভিড-১৯ মহামারির কারণে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে শিশুদের ওপর। করোনার ভয়াল থাবায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অর্থ সংকট আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিশু গৃহকর্মে, ইটের ভাটায়, কলকারখানায়, হোটেলে, গণপরিবহনে শ্রম বিক্রি করছে। অনেকেই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের অনেকেই আর স্কুলে ফিরতে পারবে না।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এ শ্রম অনুমোদনযোগ্য। অথচ এ আইনকে তোয়াক্কা না করে শিশুশ্রম চলছে দেশের সর্বত্রই! যা শিশু সুরক্ষা তথা শিশু অধিকারের পরিপন্থি! বাংলাদেশ সরকার ছাড়াও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা শিশুশ্রম রোধে নানাবিধ কাজ অব্যাহত রাখলেও শিশুশ্রম কমছে না। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে ৩২ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে, যার মধ্যে ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত; যা তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও নৈতিকতার জন্য ক্ষতিকারক।
পৃথিবীজুড়েই শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করতে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক কর্মসূচি গৃহীত হলেও শিশু নির্যাতন তথা শিশু অধিকার লঙ্ঘন থেমে নেই। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিশু অধিকার সনদে মূলনীতি হিসেবে বৈষম্যহীনতা, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা, শিশুর অধিকার সমুন্নত রাখতে অভিভাবকদের দায়িত্ব ও ‘শিশুদের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন’-এর কথা উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশে এর যথাযথ প্রয়োগ তেমন দেখা যায় না। এখানে, একই ছাদের নিচে ধনীর শিশুসন্তানরা যখন ঘুমকাতুরে হয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে, একই বয়সী গৃহকর্মী নামক আরেক শিশুকে কাকভোরে উঠে রুটিন মাফিক ভারী কাজে মনোনিবেশ করতে হয়! নিয়মিত কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হলেও কোনোদিন কোনো বাড়তি প্রশংসা জোটে না। অথচ একদিন ব্যতিক্রমী কিছু ঘটলেই জোটে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন!
শিশুশ্রম কেবল একটি শিশু বা তার পরিবারকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে না বরং অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলে তার সব সম্ভাবনা! মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি শিক্ষা। কিন্তু অনুকূল পরিবেশের অভাবে অন্য আরেকটি মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ অন্ন জোগাড় করতে অনেক শিশুকে শৈশবেই শ্রমিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। একশ্রেণির স্বার্থপিপাসু মানুষ দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে নামমাত্র পারিশ্রমিকে শিশুদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শ্রম নিয়োগ সম্পর্কে যে মান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেখানে মূলত চারটি মাত্রার কথা বলে হয়েছে : সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, যৌথ দরকষাকষির অধিকার, শিশু শ্রমিকের বৈষম্যহীন নিয়োগ ব্যবস্থা। এগুলো নিশ্চয়ই সব দেশে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, এর প্রয়োগকৌশল নিয়ে। দিন, মাস, বছর যায়! সময়ের পরিক্রমায় শিশু দিবস, শিশু অধিকার সপ্তাহ, শিশুশ্রম দিবস, মানবাধিকার দিবস পালিত হয়। বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়! কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, শিশুদের অধিকার কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয় না! বন্ধ হয় না শিশুশ্রম!
সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের আওতায় শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে শিশুশ্রম কমবে না, শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। সুন্দর আগামীর জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি প্রয়োজন প্রতিটি শিশুর জন্য আন্তরিক ভালোবাসা! নয়তো এই শিশুরাই আগামীতে গর্বিত নাগরিক না হয়ে নানান অপকর্মে জড়িয়ে যাবে! যেকোনো সচেতন ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিই চাইবেন শিশুশ্রম বন্ধ হোক, প্রতিষ্ঠিত হোক শিশু অধিকার! আমরাও প্রত্যাশায় আছি সেদিনের।
উন্নয়নকর্মী
aronnyok@gmail.com