ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
মানবহৃদয়ে সবচেয়ে নোংরা ও ক্ষতিকর কাজ হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, অমঙ্গল কামনা, পারস্পরিক শত্রুতা ইত্যাদি। এগুলোর উপস্থিতি হৃদয়কে কলুষিত করে, ভারাক্রান্ত করে, আল্লাহর জিকির থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং সর্বোপরি অন্যান্য নেক আমল নষ্ট করে দেয়। হাদিসের আলোকে মুসলমান মুসলমানে হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতার দুটি ভয়ংকর পরিণতির কথা জানতে পারি। প্রথমত, আল্লাহর বিশেষ ক্ষমা লাভ থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
বিজ্ঞাপনআবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : প্রতি সপ্তাহে দুইবার—সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দাদের কর্ম (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। তখন সব মুমিন বান্দাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, শুধুমাত্র ওই ব্যক্তি ছাড়া, যার ও তার অন্য ভাইয়ের মধ্যে বিদ্বেষ ও শত্রুতা আছে। এদের বিষয়ে বলা হয়, এদের বিষয় স্থগিত রাখো, যতক্ষণ না এরা ফিরে আসে। (মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৫)
অন্য হাদিসে মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত্রে (১৪ই শাবানের দিবাগত রাতে) আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং তাঁর সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, শুধুমাত্র শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি এবং যে ব্যক্তির সঙ্গে অন্য ভাইয়ের বিদ্বেষ আছে তারা ছাড়া। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহিহাহ, হাদিস : ১১৪৪)
দ্বিতীয়ত, সব নেক কর্ম ও ধর্ম ধ্বংস করে দেয়। জুুবাইর ইবনুল আউআম (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ব্যাধি তোমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে : হিংসা ও বিদ্বেষ। এই বিদ্বেষ মুণ্ডন করে দেয়। আমি বলি না যে তা চুল মুণ্ডন করে, বরং তা দ্বিন বা ধর্মকে মুণ্ডন ও ধ্বংস করে দেয়। আমার প্রাণ যাঁর হাতে তাঁর শপথ করে বলছি, বিশ্বাসী না হলে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর পরস্পরে একে অন্যকে ভালো না বাসলে তোমরা বিশ্বাসী বা মুমিন হতে পারবে না। এই ভালোবাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম আমি শিখিয়ে দিচ্ছি, সর্বত্র ও সর্বদা পরস্পরে সালাম প্রদানের প্রথা প্রচলিত রাখবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৫১০)
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে দুর্বল সূত্রে বর্ণিত অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, খবরদার! হিংসা থেকে আত্মরক্ষা করবে; কারণ হিংসা এমনভাবে নেক কর্ম ধ্বংস করে ফেলে, যেভাবে আগুন খড়ি বা খড়কুটো পুড়িয়ে ফেলে। ’ হাদিসটির সনদে দুর্বলতা আছে, তবে উপরের হাদিসের অর্থ তা সমর্থন করে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯০৩)
অন্যায়ের ঘৃণা করা বনাম হিংসা ও অহংকার
আরেকটি বিষয় আমাদের সমস্যায় ফেলে দেয়। আমরা জানি যে শিরক, কুফর, বিদআত, হারাম, পাপ ইত্যাদিকে ঘৃণা করা এবং যারা এগুলোতে লিপ্ত বা এগুলোর প্রচার-প্রসারে লিপ্ত তাদের ঘৃণা করা আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ঈমানি দায়িত্ব। আমরা এই দায়িত্ব ও হৃদয়কে মুক্ত রাখার মধ্যে কিভাবে সমন্বয় সাধন করব?
এই বিষয়টিকে শয়তান অন্যতম ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে, যা দিয়ে সে অগণিত ধার্মিক মুসলিমকে হিংসা, হানাহানি, আত্মতৃপ্তি ও অহংকারের মতো জঘন্যতম কবিরা গুনাহের মধ্যে নিপতিত করছে। এই ফাঁদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য সংক্ষেপে নিম্নের বিষয়গুলো স্মরণ রাখতে হবে।
প্রথমত, পাপ, অন্যায়, জুলুম-অত্যাচার, শিরক, কুফর, বিদআত বা নিফাককে অপছন্দ করতে হবে রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর অনুসরণে ও তাঁর প্রদত্ত গুরুত্ব অনুসারে। তিনি যে পাপকে যতটুকু ঘৃণা করেছেন, নিন্দা করেছেন বা যতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন ততটুকু গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁর পদ্ধতি ও সুন্নতের বাইরে মনগড়াভাবে ঘৃণা করলে তা হবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইসলামের নামে নিজের ব্যক্তি আক্রোশ বা অহংকারকে প্রতিষ্ঠা করা ও শয়তানের আনুগত্য করা।
এ ক্ষেত্রে বর্তমানে বেশির ভাগ ধার্মিক মানুষ কঠিন ভুলের মধ্যে নিপতিত হন। কোরআন ও সুন্নাহে বর্ণিত কঠিন পাপগুলোকে আমরা ঘৃণা করি না বা বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করি না, কিন্তু যেগুলো কোনো পাপ নয়, কম ভয়ংকর পাপ বা যেগুলোর বিষয়ে কোরআন-হাদিসে স্পষ্ট নির্দেশ না থাকায় আলেমরা মতভেদ করেছেন সেগুলো নিয়ে হিংসা-বিদ্বেষে নিপতিত হই। আমাদের সমাজের ধার্মিক মুসলিমদের দলাদলি, গিবত-নিন্দা ও অহংকারের ভিত্তি শেষ দুই-তিন পর্যায়ের সুন্নত-নফল ইবাদত। আমরা কুফর, শিরক, হারাম উপার্জন, মানুষের ক্ষতি, সৃষ্টির অধিকার নষ্ট, ফরজ ইবাদত ত্যাগ ইত্যাদি বিষয়ে তেমন কোনো আলোচনা, আপত্তি, বিরোধিতা বা ঘৃণা করি না; অথচ নফল নিয়ে কি ভয়ংকর হিংসা ঘৃণার সয়লাব। অনেক সময় এসব নফল, ইখতিলাফি বিষয় অথবা মনগড়া কিছু ‘আকিদা’কে ঈমানের মানদণ্ড বানিয়ে ফেলি।
ফরজ সালাত যে মোটেও পড়ে না তার বিষয়ে আমরা বেশি চিন্তা করি না, কিন্তু যে সুন্নত সালাত আদায় করল না, বা সালাতের মধ্যে টুপি বা পাগড়ি পরল না, অথবা সালাতের শেষে মোনাজাত করল বা করল না, অথবা সালাতের মধ্যে হাত উঠাল বা উঠাল না ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমরা হানাহানি ও অহংকারে লিপ্ত আছি।
সবচেয়ে বড় কথা, মুমিনকে নিজের গুনাহের চিন্তায় ও আল্লাহর জিকিরে ব্যস্ত থাকতে হবে। অন্যের কথা চিন্তা করা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া পাপ বা পাপীর চিন্তায় নিজের হৃদয়কে ব্যস্ত রাখা খুবই অন্যায়। এই চিন্তা আমাদের কঠিন ও আখিরাত বিধ্বংসী পাপের মধ্যে ফেলে দেয়। এটা আত্মতৃপ্তি ও অহংকার। যখনই আমি পাপীর চিন্তা করি, তখনই আমার মনে তৃপ্তি চলে আসে, আমি তো তার চেয়ে ভালো আছি। তখন নিজের পাপ ছোট মনে হয় এবং নিজের কর্মে তৃপ্তি লাগে। আর এটাই ধ্বংসের অন্যতম পথ। এ জন্য সাধ্যমতো সর্বদা নিজের দ্বিনি বা দুনিয়াবি প্রয়োজন বা আল্লাহর জিকির ও নিজের পাপের চিন্তায় নিজেকে রত রাখুন। হৃদয় পবিত্র থাকবে এবং আপনি লাভবান হবেন। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।
(রাহে বেলায়াত থেকে পরিমার্জিত চয়ন)