আধুনিক অর্থনীতিতে ‘কালো টাকা সাদা করা’ একটি বহুল আলোচিত বিষয়। উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো বরাবরই কালো টাকা সাদা করার অবকাশ দেয়। প্রশ্ন হলো, ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে কালো টাকা সাদা করা তথা অবৈধ সম্পদ বৈধ করার কোনো উপায় আছে? নিম্নে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে।
অবৈধ সম্পদ কি বৈধ হয়? : সম্পদের ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়তের মূলনীতি হলো কোনো অবৈধ সম্পদ বৈধ হয় না।
বিজ্ঞাপনসুতরাং আল্লাহ যা হারাম বলেছেন তা হারাম এবং যা হালাল বলেছেন তা হারাম হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, তোমরা কি ভেবে দেখেছ আল্লাহ তোমাদের যে জীবিকা দান করেছেন তোমরা তার কিছু হালাল ও কিছু হারাম করেছ? বলুন, আল্লাহ কি তোমাদের এর অনুমতি দিয়েছেন, না তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করছ?’ (সুরা ইউনুস, আয়াত ৫৯)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, জাহেলি যুগের লোকেরা কিছু জিনিস খেত এবং ঘৃণাবশত কিছু জিনিস পরিহার করত। এ অবস্থায় আল্লাহ তাঁর নবী (সা.)-কে প্রেরণ করলেন এবং তাঁর কিতাব অবতীর্ণ করলেন। তাতে কিছু জিনিস হালাল করলেন ও কিছু জিনিস হারাম করলেন। তিনি যা হালাল করেছেন তা হালাল এবং যা হারাম করেছেন তা হারাম, আর যেগুলো সম্পর্কে নীরব থেকেছেন তাতে ছাড় দেওয়া আছে। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৮০০)
আছে দায়মুক্তির উপায়
কোনো মুসলমানের হাতে থাকা সম্পদ যদি অবৈধ হয়, তবে তা রেখে দেওয়া তার জন্য বৈধ হবে না। উক্ত সম্পদ পরিহার করতে হবে। তবে মুসলিম ব্যক্তি চাইলে অবৈধ সম্পদের দায় থেকে মুক্ত হতে পারে। আর তা নির্ভর করে সম্পদ উপার্জনের পদ্ধতির ওপর। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো—
১. অবৈধ পণ্যের মালিকানা : কেউ যদি কোনো সত্তাগত হারাম বা অবৈধ পণ্যের মালিক হয়, তবে সে এই পণ্য থেকে কোনো প্রকার উপকার লাভ করতে পারবে না। চাই তা সে বৈধ পদ্ধতি লাভ করুক বা অবৈধ পদ্ধতিতে, স্বেচ্ছায় লাভ করুক বা অনিচ্ছায়—সর্বাবস্থায় এই পণ্য ধ্বংস করে ফেলতে হবে। এটা সংরক্ষণ, অন্যকে হস্তান্তর, বিক্রয় বা তার বিনিময়ে কোনো পণ্য বা সেবা অর্জন করতে পারবে না। যেমন মাদক দ্রব্য, শূকর ইত্যাদি।
২. ছিনিয়ে নেওয়া সম্পদ : অন্য কারো সম্পদ তার অনুমতি ও সন্তুষ্টি ছাড়া কেড়ে নিলে তা ব্যক্তির জন্য হারাম হয়। যেমন চুরি, ডাকাতি বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করা, ধোঁকা ও প্রতারণার মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করা অথবা ব্যবসায়ী জোরপূর্বক যে অর্থ গ্রাহকের কাছ থেকে রেখে দেয়, ঘুষ ইত্যাদি। এমন সম্পদ থেকে দায়মুক্তির জন্য তা মালিককে ফিরিয়ে দিতে হবে। ছিনিয়ে নেওয়া সম্পদ ব্যয় হয়ে গেলে তার মূল্য পরিশোধ করতে হবে। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওজি (রহ.) বলেন, ‘ছিনিয়ে নেওয়া সম্পদ হলো যা মালিকের সন্তুষ্টি ও বিনিময় ছাড়া গ্রহণ করা হয়। এমন সম্পদ মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া আবশ্যক। যদি তা অসম্ভব হয়, তবে তার মূল্য ঋণ হিসেবে পরিশোধ করবে। যদি তা অসম্ভব হয়, তবে মালিকের ওয়ারিশদের কাছে তা হস্তান্তর করবে। যদি তাদের দেওয়াও সম্ভব না হয়, তবে সদকা করে দেবে। ’ (জামিউল ফিকহ : ৪/১৭২)
৩. না জেনে হারাম উপার্জন : যদি কোনো ব্যক্তি ইসলামী শরিয়তের জ্ঞান না থাকার কারণে হারাম পদ্ধতিতে সম্পদ অর্জন করে, তবে তার উপার্জিত সম্পদের কোনো কিছুই ত্যাগ করতে হবে না। সে এই সম্পদ দ্বারা উপকৃত হতে পারবে। শর্ত হলো, জানার পর সে উপার্জনের এই পদ্ধতি ত্যাগ করবে এবং আর কখনো তাতে লিপ্ত হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যার কাছে তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই এবং তার ব্যাপার আল্লাহরই ইচ্ছাধীন। আর যারা পুনরায় আরম্ভ করবে তারাই অগ্নি-অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫)
যেমন কোনো ব্যক্তি না জেনে সুদি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করল এবং সেখান থেকে বেতন নিল। অতঃপর শরিয়তের বিধান জানতে পারল এবং সেই প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে দিল। এমন অবস্থায় তার জন্য সুদি প্রতিষ্ঠানের বেতন ফেরত দেওয়া বা তা দান করা আবশ্যক নয়। (ফাতাওয়া লাজনাতুদ দায়িমা : ১৫/৪৬)
৪. জেনে-বুঝে হারাম উপার্জন : কোনো ব্যক্তি যখন জেনে-বুঝে হারাম উপার্জন করে এবং যার কাছ থেকে সম্পদ গ্রহণ করছে তার সন্তুষ্টিও থাকে, তবে এমন সম্পদ মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া আবশ্যক নয়, তা সদকা করে দেওয়া আবশ্যক। যেমন অবৈধভাবে দখলকৃত বাড়ির ভাড়া, মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে নেওয়া টাকা, মাদক ব্যবসার লভ্যাংশ ইত্যাদি।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম জাওজি (রহ.) বলেন, ‘যদি অন্যায়ভাবে নেওয়া অর্থ মালিক সন্তুষ্টির সঙ্গে অর্পণ করে, তবে তা দাতাকে ফিরিয়ে দেওয়া আবশ্যক নয়। কেননা সম্পদের মালিক সন্তুষ্টির সঙ্গেই তা অর্পণ করেছে। ’ (জামিউল ফিকহ : ৪/১৭৪)
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সত্তাগত হারাম পণ্যের বিনিময় গ্রহণ করে অথবা তার মাধ্যমে কোনো উপকার লাভ করে; যেমন মদ বহনের বিনিময়ে মজুরি নেওয়া, মূর্তি নির্মাণ করে মজুরি নেওয়া সে যেন তা সদকা করে দেয় এবং এই হারাম উপার্জনের ব্যাপারে তাওবা করে। আশা করা যায়, সদকা তার পাপের কাফফারা (প্রতিবিধান) হবে। ’ (মাজমুউল ফাতাওয়া : ২২/১৪২)
প্রশ্ন হলো, সে কি পরিমাণ অর্থ দান করবে? যদি ব্যক্তি ধনী হয় এবং হারাম উপার্জনের পরিমাণ সম্পদ দান করার সক্ষমতা রাখে, তবে সেই পরিমাণই দান করবে। আর যদি অসচ্ছল হয়, তবে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অল্প অল্প দান করতে থাকবে।
৫. যে সম্পদে হালাল-হারামের মিশ্রণ আছে : অবৈধ সম্পদ যদি মিশ্র হয়—যার কিছু বৈধ আর কিছু অবৈধ। যার একটিকে অপরটি থেকে পৃথক করা যায় না। সব ফকিহ একমত যার হাতে এই মিশ্র সম্পদ আছে তার অন্য সম্পদ থেকে অবৈধ পরিমাণ সম্পদ আলাদা করা এবং তা প্রাপ্য ব্যক্তিকে প্রদান করা আবশ্যক। তা করলেই কেবল অবশিষ্ট সম্পদ ব্যক্তির জন্য বৈধ হবে। অবশ্য সুফি আলেমরা এই ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে সমগ্র সম্পদ ত্যাগ করার পরামর্শ দেন। আল্লামা মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.) বলেন, বৈধ সম্পদের সঙ্গে যদি অবৈধ সম্পদ এমনভাবে মিশে যায় যে তা পৃথক করা যায় না। অতঃপর (অনুমানভিত্তিক কিছু) অবৈধ সম্পদ পৃথক করা হয়, তবে উক্ত সম্পদ বৈধ হবে না। কেননা সম্ভাবনা থাকে যে অংশ পৃথক করা হয়েছে সে অংশটাই বৈধ আর যে অংশ থেকে গেছে সে অংশটাই অবৈধ। (আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা, সম্পদ অধ্যায়)
আল্লাহ সবাইকে বৈধ জীবিকা দান করুন। আমিন