এডভোকেট মো: শামসুল হুদা ।।
আমরা যারা ১৯৮০-১৯৯৫ সাল এর ভেতর জন্মেছি; বিশেষ কিছু ছিলাম, এমন না। তবে, আমরা যথেষ্ট ভাগ্যবান ছিলাম। এটা বলতেই পারি!
যখন আমরা ছোট ছিলাম…. হাতগুলো জামার মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে বলতাম- আমার হাত নেই! একটা কলম ছিল। যার চারটে বোতাম। চার দিকে ৪টা কালি। আমরা তার চারটে বোতাম একসাথে টেপার চেষ্টা করতাম!
দরজার পেছনে লুকিয়ে থাকতাম কেউ এলে চমকে দেবো বলে। সে আসতে দেরি করছে বলে অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে আসতাম! ভাবতাম, আমি যেখানে যাচ্ছি চাঁদটাও আমার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে!
৯৫ এর কোনো এক বিকেলে যেদিন প্রথম বিদ্যুৎ এলো। জ¦লে উঠল বৈদ্যুতিক বাতি। বাড়ি জুড়ে ‘কারেন্ট আইছে’ চিৎকার! সেকি উচ্ছাস! সেটাকি আর বলে বুঝানো যায়! সুইচের দু’দিকে আঙ্গুল চেপে সুইচটাকে অন্-অফ এর মাঝামাঝি অবস্থায় আনার সেকি চেষ্টা! তখন আমাদের শুধু একটা জিনিসের খেয়াল রাখার দায়িত্ব ছিলো, স্কুলে যাওয়ার পর বই-খাতা-কলম। তবে কলম হারানোটাও ছিল নিত্য দিনের ব্যাপার!
ক্লাসে বসে কলম-কলম খেলা। খাতায় ক্রিকেট। চোর-পুলিশ। মঙ্গল কাটা। গাছে উঠে বানর ঝোলা। আরো কত কি! টিফিনের সময় কটকটি, কলা বিস্কিট, চিনি বিস্কিট, ক্রিম রোল, মোনাক্কা, চারানি বিস্কিট, আটানি বিস্কিট, চারানি-আটানি আইসক্রিম, পাইপ আইসক্রিম, হাওয়াই মিঠাই না খেতে পারলে মনটাই খারাপ হয়ে যেত! চারানি সেই পাইনএপেল চকলেটের স্বাদ, আহারে সেই স্বাদ, সেকি ভূলা যায়!
নারিকেল গাছের পাতা টেনে ঝুলে থাকতাম! স্কুলে সিড়ি দিয়ে না নেমে রেলিংয়ে বসে স্লিপ খেয়ে নামার মজাই ছিল অন্যরকম। স্কুল ছুটি হলে দৌঁড়ে বাসায় আসতাম মিনা কার্টুন, শক্তিমান, উডি উড পেকার, বেনানাস এন্ড পায়জামাস দেখতে হবে তো।
শুক্রবার সকালে টারজান, মুগলি, দুপুর ৩টা থেকে অপেক্ষা। কখন বিটিভিতে বাংলা সিনেমা শুরু হবে! সন্ধ্যার পর আলিফ লায়লা, সিন্দাবাদ, রবিনহুড, হাতিম তাই, মহিশুরের টিপু সুলতান, টিম নাইট রাইডার, হারকিউলিস, দি এক্স ফাইলস, রাতে আজ রবিবার, রূপনগর, অয়োময়, কিংবা সংশপ্তক টাইপ বাংলা নাটকের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নাটকগুলা দেখার জন্য পুরো সপ্তাহ বেকুল হয়ে অপেক্ষা করতাম।
ফলের বিচি খেয়ে ফেললে দুশ্চিন্তা করতাম। পেটের মধ্যে এবার গাছ হবে, মাথার উপর দিয়ে গাছ গজাবে, গাছ বড় হলে মাথায় নিয়ে হাটব কিভাবে! কারো মাথার সাথে মাথার ঠুকা লাগলে ২য় বার ঠুকা লাগানোর সেকি চেষ্ঠা। না হলে যে মাথায় শিং গজাবে। অনেক সময় ২য় বার ঠুকা দিতে কারো কারো সঙ্গে ঝগড়াও লেগে যেতো।
ঘরের মধ্যে ছুটে যেতাম, তারপর কি দরকার ভুলে যেতাম। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর মনে পড়ত! যখন আমরা ছোট ছিলাম তখন ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলতাম কবে যে বড় হবো, আর এখন মনে হয়, কেন যে বড় হলাম!
বিকেলে কুতকুত, আলু চুরি, গোল্লা ছুট, বন্ধি খেলা না খেললে বিকেলটাই মাটি হয়ে যেত। অগ্রহায়নের পর মাঠে ঘুড়ি উড়ানো। আর ক্ষীরা ক্ষেত থেকে ক্ষীরা চুরি। আমের দিনে লবন মরিচের কৌটা আরর নেইল কাটারের ছুড়ি সঙ্গে না থাকলে কি আর চলে!
ফাইনাল পরীক্ষার পর সকালে পড়া নাই, এত্ত আনন্দ কোথায় ধরি! ব্যাডমিন্টন, ক্যারাম, সাপ-লুডু না খেললে কি হয়! ক্রিকেট খেলাটা তো বার মাস। মাঠ নেই তো কি, রাস্তা আছে না! বৃষ্টিতে ফুটবল না শুধু, আমরা দিনের পর দিন ক্রিকেটও খেলেছি। অথচ একটু বৃষ্টি হলেই ক্রিকেট ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়ে যায়, কি আজব! ডিসেম্বর মাস আর শীতকালটা আমাদের ছেলেবেলায় এমনি কালারফুল ছিল যে, কি বলব! তবে ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ যত এগিয়ে আসত মনের মধ্যে ভয় তত বেড়ে যেতো, ওইদিন যে ফাইনালের রেজাল্ট!
আজকাল ছেলে-মেয়েদের শীতকাল, গরমকাল নাই! রুটিন সেই একটাই। বাসা, স্কুল, কলেজ, কোচিং, ফেসবুক, চ্যাট! আর খেলা সেতো অই মোবাইল গেমেই তৃপ্ত! আর আমরা কলেজে উঠার আগ পর্যন্ত মন খারাপ, ফ্রাসটেশন কি জিনিস বুঝতামই না।
মন খারাপ মানে হইল বাংলাদেশের খেলার দিনে ম্যাচের সময় প্রাইভেট থাকা! বছরের পর বছর অপেক্ষার পর একটা ম্যাচ! ৮০ থেকে ৯৫ এর ছেলেবেলার সে দিনগুলোতে আমরা হয়ত ক্ষেত ছিলাম, আমাদের এত এত উচ্চমার্গীয় জ্ঞান ছিল না, হয়ত লেমও ছিলাম! কিন্তু আমাদের সারাজীবন মনে রাখার মত একটা ছেলেবেলা ছিল!
আমি জানি আমাদের জেনারেশনের যারা এগুলো পড়ছে, অনেকেই নস্টালজিয়ায় ভুগছে!
অবশেষে আমি পেয়েছি ছোটবেলায় সবথেকে বেশিবার জিজ্ঞাসিত প্রশ্নটার উত্তর!
তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও?
উত্তর- ‘আবার ছোট হতে চাই’
যেই বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে শৈশবটাই কাটিয়ে দিলাম। আজ দুঃখটা সেখানেই। কেন এতো তারাতারি বড় হয়ে গেলাম। শৈশবটা কেনো এতো তারাতারি হারিয়ে গেলো?
লেখক:
এডভোকেট মো: শামসুল হুদা। এলএলবি (অনার্স), এলএলএম। জজ কোর্ট, ঢাকা।
E-mail: sm.samsul.huda@gmail.com