মুফতি আতিকুর রহমান:
ইবাদতসমূহের মধ্যে রোজার প্রতিদান ব্যাপক। রোজার প্রতিদানে দেওয়া হবে অগণিত সওয়াব। মহান আল্লাহ বিশেষভাবে ঘোষণা করেছেন, রোজা কেবল তাঁরই জন্য। মূলত সকল ইবাদতই তাঁর জন্য। তবুও রোজাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হলো, রোজাদার কেবল আল্লাহর জন্যই সারাদিন পানাহার ও কামাচার পরিহার করেন।
রোজায় লোক দেখানোর বিষয়টি খুব কম। কেননা অন্যান্য ইবাদতের আকৃতিগত রূপ আছে। যেমন- যখন নামাজ আদায় করা হয়, যাকাত প্রদান করা হয়, হজ পালন করা হয় তখন অন্যান্য মানুষ তা দেখে বুঝতে পারে যে, অমুক ইবাদত পালন করা হচ্ছে। তাই এসব ইবাদতে রিয়া বা লোক দেখানোর অসুখ ইবাদতকারীর মনে প্রবেশ করতে পারে।
পক্ষান্তরে রোজা এমন এক ইবাদত যেটার উল্লিখিত ইবাদতসমূহের মতো বিশেষ কোনো আকৃতিগত রূপ নেই। তাই কেউ রোজাদারকে দেখে বুঝতে পারে না, সে রোজা রেখেছে কি না। সে রোজা রেখেছে কি না, তা জানেন কেবল আল্লাহ তায়ালা। তাই রোজায় লোক দেখানোর বিষয়টি সাধারণত সামনে আসে না। তবে রোজার ক্ষেত্রেও রিয়া বা লোক দেখানোর বিষয়টি সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা রোজার কাঠামো ও ক্রিয়াকলাপকে অন্যান্য ইবাদত থেকে আলাদা করে এমনভাবে সাজিয়েছেন, যাতে রোজায় একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি ব্যতিত অন্য কোনো উদ্দেশ্য না থাকে। আর মানুষ রোজা রাখেও সেই উদ্দেশ্যে। তবুও বিভিন্ন কারণে সেই উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়ে যেতে পারে। সেই উদ্দেশ্য ব্যাহত হলে রোজা কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না।
আল্লাহ তায়ালা রোজায় যে অগণিত সওয়াব রেখেছেন তা পরিপূর্ণভাবে অর্জন করার জন্য শুধু না খেয়ে থাকলেই হবে না। বরং রোজার হক আদায় করতে হবে। রোজার আদব রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় রোজা হবে সওয়াবহীন।
রোজার হক ও আদব রক্ষার জন্য করণীয় হলো, প্রথমত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একনিষ্ঠভাবে রোজাপালন করতে হবে। কেননা তা ছাড়া কোন ইবাদতই গ্রহণীয় হয় না। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, তারা আদিষ্ট হয়েছে আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে। সুরা বাইয়িনাহ, আয়াত: ৫
শুধু উদরকে খাবার থেকে এবং প্রবৃত্তিকে কামাচার থেকে বিরত রাখার নাম রোজা নয়। এগুলোর সঙ্গে জিহ্বা, কান ও চোখেরও রোজা রয়েছে। তাই জিহ্বাকে মন্দ কথা থেকে, কানকে অশ্লীল শ্রবণ থেকে এবং চোখকে অশালীন দৃশ্য থেকে বিরত রাখতে হবে। তবেই রোজার পূর্ণ সওয়াব পাওয়া যাবে।
রোজা রেখে জিহ্বাকে সংযত করতে না পারলে রোজা হবে সওয়াবহীন। জিহ্বা অধিকাংশ অনিষ্টের মূল। অধিকাংশ গোনাহের কাজ সংগঠিত হয় জিহ্বার মাধ্যমে। তাই রোজা রেখে মিথ্যা বলা, পরনিন্দা করা, কুৎসা রটানো, ঝগড়া করা, গালি দেয়া ও অশ্লীল কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত সুফিয়ান ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি একদিন রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! যে জিনিসগুলো আপনি আমার জন্য ভয়ের বস্তু বলে মনে করেন, তার মধ্যে অধিক ভয়ঙ্কর কোন জিনিস? হজরত সুফিয়ান (রা.) বলেন, এটা শুনে রাসুল (সা.) নিজের জিহ্বা ধরে বললেন, এটা। সুনানে তিরমিজি ২৫৬৬
যেসব কথা মুখে বলা নাজায়েজ সেসব কথার প্রতি কর্ণপাত করারও একই হুকুম। যদি অশ্রাব্য কোনো কথা কানে চলে আসে কিংবা কোন মজলিসে যদি কারও গীবত হতে থাকে তাহলে আবশ্যক হলো তা করতে নিষেধ করা, না শুনলে উক্ত স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়া। অন্যথায় ইচ্ছাকৃতভাবে অশ্রাব্য কথা ও গীবত শ্রবণ করার কারণেও রোজা সওয়াবহীন হয়ে যাবে। কেননা অশ্রাব্য কথা বলা ও গীবত করা যেমন অপরাধ ঠিক একই অপরাধ অশ্রাব্য কথা ও গীবত শোনা।
গীবত বা পরনিন্দা চর্চা করতে নিষেধ করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। সুরা হুজরত, আয়াত: ১২
আমাদের জীবন চলায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গোনাহের মধ্যে চোখের একটি বিশাল অংশ রয়েছে। চোখকে বলা হয় মনের আয়না। যে কোনো কাজ করার আগে চোখ প্রথমে তা দেখে এবং পরে মনকে প্রলুব্ধ করে। মনকে প্রবৃত্তি থেকে ফিরিয়ে রাখতে চোখের সংযমের গুরুত্ব অনেক।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত। আর মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে। সুরা নুর, আয়াত: ৩০-৩১
ইবাদতসমূহের মধ্যে পাপ মার্জনায় রোজা বেশ শক্তিশালী। রোজা পাপকে জ্বালিয়ে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে তোলে। আর পরকালের জন্য সঞ্চয় করে অজস্র পূণ্য। যার আধিক্যের কোনো হিসাব মানুষের ধরাছোঁয়ায় নেই। এই যে রোজার অবর্ণনীয় সওয়াব— তা যথাযথভাবে অর্জন করার জন্য প্রয়োজন জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিনিষেধ মেনে চলা। অন্যথায় রোজা হবে কেবল না খেয়ে থাকা।
লেখক: ধর্মীয় নিবন্ধকার