পরিপাটি সোনালি চুল, ছিপছিপে গড়ন, পরনে সাদা শার্ট—এভাবেই খবর পড়ছেন এক ব্যক্তি। ওই ব্যক্তি কাজ করেন ‘হাউস অব নিউজ’ নামে একটি অনলাইন নিউজ চ্যানেলে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট ইংরেজিতে তিনি বলছেন, ‘ভেনেজুয়েলা একটি গরিব দেশ, এটা কতটুকু সত্য?’
কিন্তু খবর পড়া ওই ব্যক্তি কোনো সাংবাদিক বা উপস্থাপনক নন। আদতে তিনি মানুষই নন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে বানানো চরিত্র বা অবতার তিনি। এটি এখন বিশ্বজুড়ে ভুয়া তথ্য ও গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
‘হাউস অব নিউজের’ খবরের নিচে সাবটাইটেল দেওয়া থাকে। যে কেউ সহজেই এসব খবর বুঝতে পারে। খবরের ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করা হয়। চ্যানেলটি ভেনেজুয়েলা সরকারের হয়ে পক্ষপাতমূলক সংবাদ প্রচার করে। এটা নিয়ে দেশটিতে ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনাও হয়েছে।
এমন ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা (এনজিও) উইটনেসের সংবাদমাধ্যমে ব্যবহৃত প্রযুক্তিবিষয়কবিশেষজ্ঞ শিরিন আনলেন বলেন, বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নকল এবং এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বানানো অডিও–ভিডিও কনটেন্টকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচন সামনে রেখে এসব কনটেন্টকে হুমকি ধরা হচ্ছে।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উলফ নিউজ’ নামের একটি ভুয়া সংবাদ চ্যানেল শনাক্ত করে। এই চ্যানেলেও এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বানানো উপস্থাপক খবর পড়েন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির স্বার্থ রক্ষায় সংবাদ চ্যানেলটি কাজ করছে বলে অভিযোগ করা হয়।
অনলাইনে গত মাসে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ‘পৃথিবীর বাইরের জগৎ’ থেকে পাওয়া ঝুঁকির বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে এমন কোনো ভিডিও বার্তা দেননি বাইডেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সেটি বানানো হয়েছিল।
এর আগে গত বছর এমনই একটি ভাইরাল ভিডিওতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে কোকেইন নিতে দেখা যায়। আরেকটি ভিডিওতে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডোরকে আক্রমণ করে মার্কিন র্যাপার এমিনেমকে একটি গান গাইতে দেখা যায়। এসবই ছিল প্রযুক্তির কারসাজি।
সরকারি সম্পৃক্ততার অভিযোগ
হাউস অব নিউজ চ্যানেলের চরিত্র ও কনটেন্ট সিনথেশিয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বানানো হয়েছিল। শনাক্তের পর এটি নিয়ে ইউটিউব কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করে সিনথেশিয়া। পরে ওই কনটেন্ট সরিয়ে ফেলা হয়।
এই বিষয়ে সিনথেশিয়ার মুখপাত্র লরা মোরেল্লি সতর্ক করে বলেন, যদি আপনি একজন সাংবাদিক হওয়ার ভান করেন কিংবা ভুয়া ব্রেকিং নিউজ দেওয়ার চেষ্টা করেন, তবে নিষিদ্ধ করা হবে।
তবে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল ভিটিভি সমালোচিত হাউস অব নিউজের একটি ভিডিও কনটেন্ট সম্প্রচার করেছে। ওই কনটেন্টে একটি অভ্যন্তরীণ বেসবল প্রতিযোগিতা থেকে আয়–সংক্রান্ত তথ্য–উপাত্ত ছিল। যদিও কনটেন্টে সরকারি কোনো তথ্য ছিল না। এটা নিয়ে সমালোচনা হয়।
সমালোচনার মুখে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। ভুয়া ভিডিও প্রচারের পেছনে তাঁর সরকারের ভূমিকা রয়েছে, এই অভিযোগ তাঁকে ক্ষুব্ধ করে। গত মাসে মাদুরো বলেন, ‘এটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নয় বরং এটা জনপ্রিয় বুদ্ধিমত্তা।’
মিথ্যা কনটেন্ট সত্য হওয়ার ঝুঁকি
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বানানো ৯৩টি অবতার বা চরিত্র আছে হাউস অব নিউজের। এর মধ্যে দুটি নোয়াহ ও দারেন। উলফ নিউজের আছে অ্যালেক্স ও জেসন। সবাই খবর পড়ে। গত জানুয়ারিতে বুরকিনা ফাসোর একটি সেনা অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়েছে, এমন ভুয়া কনটেন্টে এসব ব্যবহার করা হয়েছে।
ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা সম্প্রতি এমন কিছু ভুয়া অ্যাকাউন্টের নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মেটার বৈশ্বিক ঝুঁকিবিষয়কপ্রধান বেন নিম্মো জানান, কিউবার বিরোধীদের সমালোচনা করার জন্য এমন ভুয়া অবতার বা চরিত্র বানানো হয়েছিল। স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব এ কোরুনার অধ্যাপক এদুয়ার্দো মসকিউয়েরা বলেন, ভুয়া কনটেন্ট শনাক্ত করা কঠিন কিছু নয়। তবে এর উত্স বোঝা বেশ কঠিন। তবে আমরা যদি একটু সতর্ক থাকি, তাহলে এটি অসম্ভব নয়। তবে ঝুঁকি হলো, বারবার একটি মিথ্যা প্রচার করতে থাকলে একসময় সেটিকে অনেকেই সত্য বলে ধরে নেয়। এই বিষয়ে নাৎসি নেতা জোসেফ গোয়েবলসের বিখ্যাত একটি উক্তি মনে করিয়ে দেন এদুয়ার্দো। গোয়েবলস বলেছিলেন, ‘এক হাজার বার একটি মিথ্যা পুনরাবৃত্তি করলে সেটি সত্যে পরিণত হয়।’