মো: হায়দার তানভীরুজ্জামান:
ডিজিটাল আদালত বলতে আসলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে গড়ে তোলা আধুনিক আদালত বোঝানো হয়। আদালতে কাজের গতি ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। আদালতের ইলেকট্রনিক ফাইলিং, কেস ম্যানেজমেন্ট এবং শুনানি পরিষেবাগুলির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একত্রিত, পক্ষ, আইনজীবী এবং আদালতকে স্বচ্ছভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে বাস্তব সময়ে যোগাযোগ করতে সক্ষম করে।
প্রতিটা সিআর মামলা ফাইলিংয়ের সময় এক কপি প্রিন্ট কপি ও এক কপি স্ক্যান কপিসহ আদালতের অফিসিয়াল ইমেইলের মাধ্যমে জমা দেওয়া যেতে পারে, এতে করে কোন ডকুমেন্টস নষ্ট বা হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই কারণ নীল হাজিরার কাগজে প্রিন্ট করা আর্জি একসময় নষ্ট হয়ে লিখা উঠে যায়।
★ কোনো আসামি গ্রেপ্তার হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের সার্ভারে অনলাইনে আপলোড করলে জি আর সেকশন (জিআরও) আগে থেকেই বুঝতে পারবে যে আজ কোন কোন নথি বের করতে হবে, কতজন আসামি প্রোডাকশন আছে।
★কোনো আসামির জামিনের পর বেল বন্ড দাখিলের সময় ‘পরোয়ানা ফেরত’ বা রি-কল অফিসিয়াল ইমেইলের মাধ্যমে আদালত হতে সরাসরি থানায় পাঠানো যেতে পারে। এই রি-কল এর শুধু স্বারক নম্বার আদালতের ওয়েবসাইটে দেওয়া যেতে পারে, যাতে থানা কর্তৃপক্ষ যাচাই করতে পারে।
★ কারাগার থেকে আসামি মুক্তির ক্ষেত্রে ডিজিটাল ভার্সন ব্যবহার করা সময়ের দাবি। কারণ কি পরিমাণ হয়রানী হতে হয় একমাত্র হাজতি আসামির পরিবারই জানে। এই পদ্ধতিতে সরাসরি আদালতের সঙ্গে জেলখানার ডিজিটাল ভার্সনে যোগাযোগ স্থাপন দরকার, অনেক ক্ষেত্রে আমরা আইনজীবীরা হাতে লিখা বেল বন্ডে দাখিলের সময় ভুল থাকলে কারাগারে হাজতি আসামি বের হতে পারে না, এইসব সমস্যার কারণে আইনজীবীদের ডিজিটাল ফিঙ্গার প্রিন্টে টিপ সই নিয়ে বেল বন্ড সরাসরি কারাগারে আদালত অফিসিয়াল ই-মেইল এর মাধ্যমে পাঠাতে পারে এবং আদালতের ওয়েবসাইট বেল বন্ড স্বারক নম্বারসহ আপলোড হতে পারে। তবে দ্রুত ও সহজভাবে কারাগার কর্তৃপক্ষ যাচাই করতে পারবে (এই সার্ভিস নিতে আসামী থেকে প্রয়োজনে সার্ভিস চার্জ নেওয়া যেতে পারে)।
★ আত্মসমর্পণের আসামী জেল হাজতে প্রেরণ হলে তা সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত অফিসারকে জানাতে হবে।
★ জিআর মামলায় পুলিশ রিপোর্ট (চার্জশীট/ফাইনাল রিপোর্ট) আসার আগ পর্যন্ত আসামিদের টিপ সই ডিজিটাল হাজিরা (ফিঙ্গার প্রিন্ট অ্যাট্যান্ডেন্স) মেশিনের মাধ্যমে নেওয়া যেতে পারে অর্থাৎ ফিঙ্গার প্রিন্ট/ ডিজিটাল টিপ সই দিয়ে আসামি হাজিরা দিয়ে চলে যাবে। যদি কারো কোনো মামলায় শুনানি বা আদালতে উপস্থিত হতে হয় তখন লাল বাতি উঠবে তবে তিনি হাজিরা দিয়ে সরাসরি নির্ধারিত আদালতে গিয়ে হাজির হবেন। (এই হাজিরা পদ্ধতিতে আসামি সার্ভিস চার্জ দিবে যার একটা অংশ সরকারি কোষাগার এ জমা হবে এবং আরেকটি অংশ আইনজীবী পাবে)। এর ফলে সঠিক ব্যক্তি হাজিরা দিবে ৫ সেকেন্ডেই এবং আদালতপাড়ার ভিড় কমে আসবে।
★ আসামিদের পক্ষে আইনজীবীরা যে কোনো জামিনের দরখাস্তের পুটাপ স্ক্যান করে ইমেইলে জমা দেওয়া যেতে পারে। পুটাপ অনুমোদন হলে সরাসরি শুনানির সময় প্রিন্ট কপি দেওয়া যেতে পারে।
★ অন্য জেলের মামলার খণ্ড নথি আদালত অফিসিয়াল ই-মেইল এর মাধ্যমে পাঠাতে পারে, বাস্তবে ডাক বিভাগের মাধ্যমে খণ্ড নথি পেতে ৩/৭/২০ দিন সময় লাগে।
★ মামলার স্বাক্ষীদের সমন পদ্ধতি মেসেজ /কল/ ইমেইলের মাধ্যমেও করা যেতে পারে।
★ বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারকার্য পরিচালনার সময় যে কারো জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট যাচাই করার ক্ষমতা দিতে হবে ম্যাজিস্ট্রেটকে তাতে আসামি/বাদীর সঠিক পরিচয়ের সত্যতা পাওয়া যাবে এবং আসামীর CDMS যাচাই করার ক্ষমতা দিলে আসামির অতীত মামলার রেকর্ডসহ কম্পিউটার এ চলে আসবে। এর ফলে একজন আসামির জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে আরেকজন জামিনের জন্য দাঁড়াতে পারবে না এবং বাদী পক্ষে স্বাক্ষী দিতে আসা লোক সঠিক স্বাক্ষী কিনা তা যাচাই করা যাবে। আত্মসমর্পণ জামিনের দরখাস্ত দাখিলের পূর্বে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইকরণ করা যেতে পারে।
★ সাক্ষ্য-প্রদান শেষে মামলায় জব্দ করা আলামত উপস্থাপনের পর পাওয়ার পয়েন্টে ভিডিও ও অডিও রেকর্ড প্রোজেক্টরের মাধ্যমে আদালতে উপস্থাপন করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
★ মেডিকেল রিপোর্ট এর ডাক্তারের স্বাক্ষী ভার্চুয়ালি নেওয়া যেতে পারে।
দেওয়ানী এখতিয়ার আদালতের বিচার কার্য বিকাল ৩টা থেকে রাত১০ টা পর্যন্ত চলতে পারে-
★ প্রতিটা দেওয়ানী মামলা ফাইলিং এর সময় এক কপি প্রিন্ট কপি ও এক কপি স্ক্যান কপি সহ আদালতের অফিসিয়াল ইমেইলের মাধ্যমে জমা দেওয়া যেতে পারে, এতে করে কোনো ডকুমেন্টস নষ্ট বা হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই কারণ নীল হাজিরার কাগজে প্রিন্ট করা আর্জি একসময় নষ্ট হয়ে লিখা উঠে যায়।
★ দেওয়ানী মামলায় কোর্ট ফি গেটওয়ে সার্ভিসের মাধ্যমে পেমেন্ট করা যেতে পারে।
★ দেওয়ানী আদালত পরিচালনার সময় সহকারী জজ দের অনলাইনে পর্চা বা দলিল যাচাই করার ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে তাকে করে বাদী/বিবাদী জাল বা বানানো কাগজ উপস্থাপন করতে পারবে না।
★ জমি দখল নিয়ে মোকদ্দমায় জমির বর্তমান অবস্থা দেখার জন্য ভিডিও নিয়ে আসার জন্য বাদীকে বলা যেতে পারে।
★ সাকসেশন মামলা গুলিতে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য জন্মনিবন্ধন, মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশসনদ অনলাইনে যাচাই করার জন্য ক্ষমতা দিলে কেউ মিথ্যা ডকুমেন্টস উপস্থাপন করতে পারবে না
পারিবারিক আদালত ডিজিটাল পদ্ধতিতে মামলা পরিচালনা পদ্ধতি-
পারিবারিক আদালতে অনেক নারী চক্ষু লজ্জার ভয়ে বা চাকুরীজীবী মাদের ছুটি থাকে না বা বাচ্চা দেখাশুনার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে আদালতে আসতে চান না, তাই তাদের জন্য ভার্চুয়াল কোর্ট করা যেতে যারে।
১) মোকদ্দমা ফাইলিং সময় এককপি প্রিন্ট আরেক কপি স্ক্যান কপিসহ দাখিল করা আদালতের অফিসিয়াল ই-মেইল এ দেওয়া যেতে পারে।
★ ফাইলিংয়ের দিন বাদীকে উল্লেখ করতে হবে তিনি মামলার হাজিরা ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হাজিরা দিবেন নাকি স্বশরীরে এবং শুধু স্বাক্ষীর সময় স্ব শরীরে হাজির থাকবেন বলিয়া উল্লেখ করবেন।
★ দেনমোহর ও ভরণপোষণ মামলায় যেহেতু টাকার অংকের ডিক্রি দেওয়া হয় তাই বিবাদীর ব্যাংক একাউন্ট / বেতন থেকে অটোমেটিক প্রতিমাসে টাকা কেঁটে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
ভার্চুয়াল ট্র্যাফিক আদালত এই পদ্ধতিতে ভার্চুয়ালি একজন ম্যাজিস্ট্রেট (মোবাইল কোর্টের) মত থাকবে তিনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। এতে করে আইন অমান্যকারী পথচারীসহ ড্রাইভারদের শাস্তির আওতায় আনা যাবে।
প্রতিটা আদালতের আদেশ ওয়েবসাইটে সর্ট করে দেওয়া যেতে পারে, যেমন ডেমরা থানা মামলা নং- ২(৩)২২, ধারা, জামিনের দরখাস্ত- আদেশ না মঞ্জুর,পরবর্তী তারিখ- ৭/১১২/২২। দেওয়ানী মোকদ্দমা ১/২০১৯,জবাব দাখিল। পরবর্তী তারিখ- ২/১২/২০২২। ক্লাউডের মাধ্যমে সকল ডাটা সংরক্ষিত হবে।
★ প্রতি আদালতের নিজস্ব একটা সরকারি মোবাইল নাম্বার থাকা উচিৎ যাতে আইনজীবীরা যোগাযোগ করে যেকোনো বিষয় জানতে পারে। সর্বপরি রাতে ভার্চুয়াল কোর্ট বা স্ব-শরীর আদালত চলতে পারে দেশের নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত।
মো. হায়দার তানভীরুজ্জামান, এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।