ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যেদিন জানালেন সরকারের সমালোচনার অর্থ দেশের বিরোধিতা নয়, তার পরদিনই কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দিল, সরকার–সংক্রান্ত খবরের সত্যতা যাচাইয়ের ভার থাকবে প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর (পিআইবির) হাতেই। কোনো খবর বা তথ্যকে পিআইবি ‘অসত্য’ বা ‘ফেক নিউজ’ জানিয়ে দিলে তা প্রচার করা যাবে না। সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছে, পিআইবি চিহ্নিত ‘ফেক নিউজ’ বা অসত্য খবর গুগল, ফেসবুক, টুইটার বা সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই নির্দেশের ফলে এই জাতীয় খবর ছাপানো বা সম্প্রচারের পুরো দায় বর্তাবে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের ওপর। সংবাদের সত্যাসত্যের প্রমাণ তাদেরই আদালতে দিতে হবে।
এডিটর্স গিল্ড অব ইন্ডিয়াসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন শুরু থেকেই নরেন্দ্র মোদির সরকারের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে আসছিল। বিতর্ক চলছিল ২০২১ সাল থেকেই। সব আপত্তি ও সমালোচনা উপেক্ষা করে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার পর এডিটর্স গিল্ড অব ইন্ডিয়া গতকাল শুক্রবার বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্ত দমনমূলক ও সেন্সরশিপের সমতুল্য।
অবশ্য কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর গতকাল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এই পদক্ষেপ বাক্স্বাধীনতা বা মৌলিক অধিকার খর্ব করবে না।
কেরালার নিউজ চ্যানেল ‘মিডিয়া ওয়ান’-এর ওপর জারি হওয়া সরকারি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়ে গত বুধবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেছিলেন, সরকারের সমালোচনার অর্থ দেশের সমালোচনা নয়, দেশ বিরোধিতাও নয়। সরকার ও রাষ্ট্র আলাদা। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার যুক্তিতে সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া যায় না। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে জাহির করাও যায় না।
সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় বৈদ্যুতিন ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে ২০২১ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সংশোধনী প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, সরকার–সংক্রান্ত জাল, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার অথবা সংগ্রহ করে রাখা যাবে না। খবরের সত্যাসত্য যাচাইয়ের ভার থাকবে পিআইবির হাতে। পিআইবি কোনো খবরকে ‘অসত্য’ বা ‘ফেক নিউজ’ বলে চিহ্নিত করলে তা প্রত্যাহার তো করতেই হবে, পাশাপাশি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাতে হবে খবরটি ভুল বা অসত্য ছিল।
পিআইবির অধীন তথ্য যাচাই ইউনিটের পরিচালন পদ্ধতি কী হবে, সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ ও নিরূপণের ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা একচেটিয়া হবে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছে এডিটর্স গিল্ড। সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় আবেদনের সুযোগও কতটা থাকছে, গিল্ড তা জানতে চেয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে গিল্ড বলেছে, এই দমনমূলক নিয়ম অত্যন্ত আক্ষেপের। সরকার এই নির্দেশ বাতিল করে বরং সংবাদ সম্প্রচার সংস্থা ও সংবাদ সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসুক।
ডিজিটাল অধিকার রক্ষা সংগঠন ‘ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের’ আশঙ্কা, ‘জাল’, ‘মিথ্যা’, ‘বিভ্রান্তিকর’ শব্দগুলো সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে নিয়মের অপব্যবহার হবে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের সংগঠনও এই বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে সরকারকে স্মারকলিপি দিয়েছে।
গণমাধ্যম সংগঠনগুলোর মতে, সাংবাদিকেরা সরকারের অনেক উদ্যোগ নিয়ে আগাম প্রতিবেদন লিখে থাকে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ওই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করা সংবাদ জগতের একটা বহু পরিচিত রীতি। সেই ধরনের কোনো খবর সরকারের অস্বস্তির কারণ হলে এই নিয়ম অনুযায়ী তাকে ‘ফেক নিউজ’ বলে দেওয়া সম্ভবপর হবে। সে ক্ষেত্রে বিপাকে পড়তে হতে পারে সংশ্লিষ্ট মাধ্যমকে। সেই সুযোগ সরকারের হাতে থাকছে।
সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের আশঙ্কা, এর ফলে দুভাবে তাঁদের অধিকার খর্ব হবে। ভারত সরকারকে নিয়ে যেকোনো খবর করার আগে সাংবাদিকদের দশবার ভাবতে হবে। ভাবতে হবে গণমাধ্যমকেও।
বিপদে পড়ার শঙ্কায় অনেকেই হাত গুটিয়ে নেবে। সরকারের সমালোচনা করার আগে অনেক কিছু ভাবতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকার যেকোনো অপ্রিয় খবরকে ‘ফেক নিউজ’ চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে।
সরকার কেন এই পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার ব্যাখ্যায় কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর বলেন, সরকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তথ্য যাচাই করা বাইরের কারও পক্ষে কঠিন। গণতন্ত্রকে কমজোরি করতে শত্রু দেশ থেকে অনেক প্রচার চালানো হয়। তা রুখতে এই পদক্ষেপ। সরকার একটা ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়। এতে কারও মৌলিক অধিকার খর্ব হবে না। বাক্স্বাধীনতাও হরণ করা হবে না।