ইসলামের ভিত্তি রাখা হয়েছে জ্ঞানের ওপর। হেরা গুহায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর প্রথম যে ওহি বা প্রত্যাদেশ এসেছিল তা ছিল জ্ঞানচর্চাসংক্রান্ত। ইরশাদ হয়েছে, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক, আয়াত : ১)
এ আয়াতে আল্লাহ জ্ঞান নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তিনিই মানুষকে কলমের ব্যবহার শিখিয়েছেন। অন্য আয়াতে আল্লাহ ও বান্দার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই (জ্ঞানী) আল্লাহকে ভয় করে।’ (সুরা ফাতির, আয়াত : ২৮)
কোরআনের এই ঘোষণা দ্বারা ইলমের (জ্ঞান) মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। কেননা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও আল্লাহভীতি লাভের জন্য জ্ঞান প্রয়োজন। তবে আল্লাহর রাসুল (সা.) সেই জ্ঞান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন, যা মানুষকে আল্লাহবিমুখ করে, যা শুধু পার্থিব অর্জনের জন্য হয়, যা মানুষের ভেতর মন্দ স্বভাব তৈরি করে এবং যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় না। আল্লামা জালালুদ্দিন রুমি (রহ.) বলেন, ‘জ্ঞানকে যদি তুমি অন্তরে জায়গা দাও তবে তা বন্ধু হবে আর জ্ঞানকে শরীরে জায়গা দিলে তা সাপ হয়ে দংশন করবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক তৈরি করা তোমার কাজ, মানুষের ভেতর বিভেদ তৈরি করা তোমার কাজ নয়।’ অর্থাৎ জ্ঞান ও জ্ঞানানুরাগ মানুষকে মহৎ হতে শেখায়, তা সামাজিক সম্প্রীতি ও কল্যাণ নিশ্চিত করে।
আল্লামা ইবনে খালদুন বলেন, জ্ঞান লাভের জন্য আলেমদের সংশ্রব প্রয়োজন। সংশ্রবে থেকে যে জ্ঞান অর্জন করা হয় তা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। ইবনে কুতাইবা তাঁর ‘আশ-শের ওয়াশ-শুআরা’ গ্রন্থে লেখেন, ‘উচ্চারণসংক্রান্ত বহু বিষয় এমন, যা শুধু বই পড়ে সমাধান করা যায় না। এ জন্য শিক্ষকের দ্বারস্থ হতে হয়। ইবনে খালদুন লেখেন, ‘জ্ঞানার্জনের জন্য সফর করা প্রয়োজন। যেন বড় বড় মনীষীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তাদের সংশ্রবে থেকে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্ববোধ অর্জন করা যায়। আলেমদের সংশ্রব খুবই কল্যাণপ্রসূ। পারস্যের কবি শেখ সাদি সান্নিধ্যের প্রভাব চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। গোলাপের সান্নিধ্যে সৌরভ লাভ করা মাটি বলে—‘বন্ধুর সৌরভ আমাকে প্রভাবিত করেছে, নতুবা আমি তো সামান্য মাটিই।’ সত্যিই জ্ঞান লাভের জন্য আলেমদের সান্নিধ্য শিক্ষার্থীদের জন্য সঞ্জীবনীতুল্য। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) আলেমদের মর্যাদার কথা নানাভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন বলেছেন, ‘একজন আলেম ও একজন সাধারণ ইবাদতকারীর মধ্যে পার্থক্য রাতের অন্ধকার ও ১৪ তারিখের পূর্ণিমার চাঁদের মতো।’
প্রকৃতপক্ষে আলেমদের অস্তিত্ব ছাড়া কোনো মুসলিমসমাজের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। প্রতিটি মুসলিমসমাজে দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ও আলেমরা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। তাদের সংগ্রাম ও সান্নিধ্যে বদলে যায় জীবন। যেমন বদলে যেত নবী-রাসুলদের সান্নিধ্যে। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আলেমরা নবীদের উত্তরাধিকারী। তারা কোনো স্বর্ণমুদ্রা বা রৌপ্য মুদ্রার উত্তরাধিকার রেখে যান না, তারা রেখে যান জ্ঞানের উত্তরাধিকার।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৬৪১)
মুসলিমসমাজ আলেমদের দ্বারা উপকৃত হয়। তাদের দ্বারা সমাজের চারিত্রিক, আত্মিক, ধর্মীয় ও জ্ঞানগত চাহিদা পূর্ণ হয়। তাদের দ্বারা ইসলামী বিশ্বাস ও সামাজিক মূল্যবোধ, ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক বন্ধন, ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য টিকে থাকে। এ জন্য যে মুসলিমসমাজে আলেম ও ইমামদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়, সে সমাজের মানুষ আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে, ভালো কাজের উদ্দীপনায়, সুপথ অনুসরণে এগিয়ে যায়। ধর্মীয় বিষয়ে তাদের জ্ঞানগত দৈন্যতাও খুব কম থাকে।
আলেমরা রাজনৈতিকভাবেও মুসলিমসমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন। ইসলামের ইতিহাসে সে দৃষ্টান্ত খুব বিরল নয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে যেমন ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি যুদ্ধের ময়দানে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন, তাতার বাহিনীকে পরাজিত করেছেন। একই ধারাবাহিকতায় গত শতাব্দীতে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকা রাখেন সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.), শাহ ইসমাইল (রহ.), মাওলানা আবদুল হাই (রহ.), মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (রহ.), শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.) প্রমুখ আলেম। তাঁরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও সংগ্রাম করেছেন। তাদের নির্যাতন ও জেল-জুলুম সহ্য করেছেন।
আলেমরাই মুসলিমসমাজের আশ্রয় ও অভিমুখ। তাঁদের অংশগ্রহণ ছাড়া সমাজে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কেননা ইসলামী শরিয়তের ব্যাপারে শুধু তাঁরাই সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার রাখেন। তাঁরাই পারেন তাঁদের জ্ঞান, গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে আধুনিক সমাজব্যবস্থার ধর্মীয় সংকটগুলো থেকে মুসলিমদের রক্ষা করতে।
ইসলাম জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে মুমিনের হারিয়ে যাওয়া সম্পদ বলেছে। সুতরাং যেখানেই তা পাওয়া যাবে তা কুড়িয়ে নেওয়া হবে। ইসলামী খেলাফতের উত্থানকালে আলেমদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভাণ্ডার একত্র করা হয়েছিল। গ্রিকদের জ্ঞানগত উত্তরাধিকার সংগ্রহ করে তা আরবিতে ভাষান্তর করা হয়। তার ব্যাখ্যা গ্রন্থ লেখা হয়; বরং তার উন্নতি সাধন করা হয়। তারা পুঁথিগত গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে প্রায়োগিক রূপ দেন এবং নিত্য নতুন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিক ধারাগুলো রসায়ন, হিসাব বিজ্ঞান ও ভূগোল শাস্ত্রের অভাবিত উন্নয়ন হয় তাঁদের মাধ্যমে। এসব শাস্ত্রের বহু শাখা ও প্রশাখার উদ্ভাবক আরব আলেমরাই। আরবদের কারণে প্রাচীন গ্রিকের বহু গ্রন্থের অস্তিত্ব রক্ষা পেয়েছে। এসব গ্রন্থের আরবি সংস্করণ না থাকলে তা পৃথিবী থেকে বিলুপ্তই হয়ে যেত। সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, আরবদের কাছ থেকে আলো পেয়েছিল ইউরোপ এবং আরব উদ্ভাবনের ওপর দাঁড়িয়েই তারা এত দূর এসেছে।
বর্তমান বিশ্বে মুসলিম সমাজে যেসব পশ্চাৎপদতা, অনৈক্য ও ধর্মহীনতা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে তা থেকেও আলেমরাই তাদের রক্ষা করতে পারেন। তাঁরা দ্বিনি শিক্ষা, নৈতিকতা, আত্মিক পরিশুদ্ধি, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্যের বন্ধনে একত্র করতে পারেন সমগ্র মুসলিম জাতিকে। এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে।
তামিরে হায়াত থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর