দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহ বিস্তারের মধ্যেও জীবন-জীবিকার বাস্তবতায় লকডাউন তুলে দেওয়া হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জেগেছে- সংক্রমণ তা হলে কমবে কীভাবে? লকডাউনের বিকল্পইবা কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ কমানোর একমাত্র বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি হচ্ছে লকডাউন। তবে এটিই একমাত্র পন্থা নয়। সবক্ষেত্রে অবশ্যই মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ এবং গণপরিবহন, অফিস-আদালত, মার্কেট, বাজারসহ যে কোনো প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব।
গত শনিবার এক ভার্চুয়াল আলোচনায় ব্রাজিলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা তুলে ধরে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র হেলথ স্পেশালিস্ট ড. জিয়া হায়দার বলেন, কোনো দেশের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জনগণ যদি ৮০ দিনের মতো সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে তা হলে করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমে যাবে। পরে ভ্যাকসিন ছাড়াই তাদের জনগণকে নিরাপদে রাখতে পারে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এ বছরের ৫ এপ্রিল থেকে ধাপে ধাপে বিধিনিষেধ চলছে। ঈদের পর ২৩ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হয়, যা প্রথমে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছিল। পরে তা ১০ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়। রবিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নতুন আদেশে জানিয়েছে, আগামীকাল বুধবার থেকে শর্তসাপেক্ষে প্রায় সব কিছুই খুলে দেওয়া হবে। ৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনাসংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লকডাউনে দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খেটে খাওয়া মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। বেকার হয়েছে লাখো মানুষ। এ কারণে লকডাউন তুলে দেশকে স্বাভাবিক গতিতে ফেরানোর চেষ্টা করছে সরকার।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন একমাত্র পন্থা নয়। এটি অন্যতম একটি ব্যবস্থা মাত্র। লকডাউন তথা জনচলাচল বন্ধ করা ছাড়াও সংক্রমিত এলাকায় ব্যাপক পরীক্ষা করা, রোগী শনাক্ত হলে তাদের আইসোলেশন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, রোগীর সংস্পর্শে আসা লোকদের খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, মাস্ক পরাসহ জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট একটি অংশকে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। কিন্তু এগুলো ঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। বারবার লকডাউন দিয়েও সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এখন শতভাগ মানুষকে মাস্ক পরানোসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করার পথে হাঁটতে হবে। বারবার লকডাউন দিলে সাধারণ মানুষ ও দেশের অর্থনীতি আরও ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সংক্রমিত ও সুস্থ ব্যক্তি উভয়ে মাস্ক পরলে সুস্থ ব্যক্তির করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে মাত্র ১০ শতাংশ। মাস্ক পরে ৩ ফুট দূরে থাকলে সংক্রমণ ঝুঁকি ১.৫ শতাংশ। আর ৬ ফুট দূরে থাকলে শূন্য শতাংশ। এখন মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান আমাদের সময়কে বলেন, লকডাউন দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়। সংক্রমণ বাড়লে তা নিম্নমুখী করতে লকডাউন দেওয়া হয়। এতে সংক্রমণ কমে আসে। কিন্তু শুধু লকডাউন দিয়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, রাজধানীসহ মহানগরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেষ্টা করেছে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে। কিন্তু এটি আরও ব্যাপকভাবে করতে হবে। সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি টিকাদান কার্যক্রম বেগবান করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, জনসাধারণকে মাস্ক পরার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ জন্য পাড়া-মহল্লায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক টিম তৈরি করতে হবে। এসব টিম মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা নেওয়া ও মাস্ক পরার বিষয়ে সচেতন করবে।