মুফতি আতিকুর রহমান:
পরের দোষ চর্চা করা জঘন্য অপরাধ। রোজা রেখে এই অপরাধে জড়ালে রোজা হবে সওয়াবহীন। পাপ মার্জনা ও ক্ষমা লাভে রোজার যে অপার্থিব শক্তি, পরের দোষ চর্চা করলে রোজার সেই শক্তি স্তিমিত হয়ে যায়। এমন রোজা মানুষের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনে না।
মানুষের যেসব অপরাধ রোজার মাহাত্ম্যকে ক্ষুণ্ণ করে, রোজার প্রতিদানকে চূর্ণ করে, সেসবের অন্যতম এই পরের দোষ চর্চা বা পরনিন্দা। তাই রোজার পূর্ণ প্রতিদান পেতে পরনিন্দা বর্জনের বিকল্প নেই।
পরনিন্দা সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, একবার রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে বললেন, তোমরা কি জানো গিবত (পরনিন্দা) কী? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তখন রাসুল (সা.) বললেন, গিবত হলো তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলা যা সে অপছন্দ করে। রাসুল (সা.) কে এক সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তবে এটাও কি গিবত হবে? রাসুল সা. বললেন, তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাহলেই তা গিবত। আর যদি তার মধ্যে না থাকে তাহলে তো তা অপবাদ। সহিহ মুসলিম ৪৬৯০
পরনিন্দা মারাত্মক দূষণীয় একটি কাজ। ইসলাম ধর্মে পরনিন্দাকে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু আজকাল পরনিন্দা ছাড়া কোনো সমাবেশ, মজলিশ ও আড্ডার আসর খুব একটা জমে না। অপরের নিন্দা করে, অপরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে মানুষ খুব আনন্দ পায়। এটা মানুষের স্বাভাবজাত প্রবৃত্তি। তাই মানুষ আনন্দ নিয়ে তৃপ্তি সহকারে খুব স্বাভাবিকভাবে পরনিন্দা ও দোষ চর্চা করে। অথচ তা গোনাহের দিক দিয়ে ব্যাভিচারের চেয়েও ভয়াবহ। এর জন্য রয়েছে কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। পরনিন্দা ভালো কাজ নয়, এই জ্ঞানটুকু মানুষের আছে। তবুও আড্ডা বা খোশগল্পের আসরে মানুষের ভেতর সেই বোধটুুকু জাগ্রত হয় না। পরনিন্দার আনন্দ অসুখের তীব্রতায় মানুষ তা অনুধাবনও করতে পারে না।
কোনো মজলিশ বা আড্ডায় পরের দোষ চর্চা শুরু হয়ে গেলে কমপক্ষে একজন মানুষের বিবেকে সেই বোধটুকু জাগ্রত হওয়া চাই। যিনি তা থেকে সকলকে নিষেধ করবেন।
পরনিন্দার ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, হে ইমানদারগণ! তোমরা অধিক ধারণা হতে বিরত থাকো। কতক ধারণা পাপের অন্তর্ভুক্ত। তোমরা অন্যের দোষ খোঁজাখুঁজি করো না, একে অন্যের অনুপস্থিতিতে দোষত্রুটি বর্ণনা করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো সেটাকে ঘৃণাই করে থাকো। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তওবাহ কবুলকারী, পরম দয়ালু। সুরা হুজরত, আয়াত: ১২
পরনিন্দার ভয়াবহতায় কখনও কখনও মানুষের মাঝে বড় সংঘাত তৈরি হয় এবং সমাজে সৃষ্টি হয় নানা বিশৃঙ্খলা। আর পরকালে পরনিন্দাকারীদের জন্য রয়েছে হুতামা নামক জাহান্নাম। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে তাদের শাস্তি সম্পর্কে বলেন, দুর্ভোগ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে সম্মুখে মানুষের নিন্দা করে আর পেছনে দুর্নাম করে। …কখনও নয়, তবে অবশ্যই সে নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায়। আর কিসে আপনাকে জানাবে হুতামা কি? তা হলো আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত আগুন। যা হৃদয়কে গ্রাস করবে। সুরা হুমাযাহ, আয়াত: ১-৭
কোরআনের আয়াতে হুতামা নামক জাহান্নামের এমন আগুনের কথা বলা হয়েছে, যে আগুন পরনিন্দাকারীর পুরো শরীরকে পুড়িয়ে হৃদয়কেও পোড়াতে থাকবে। আর পরনিন্দাকারী ব্যক্তি তীব্র যন্ত্রণায় মৃত্যু কামনা করবে। কিন্তু তার মৃত্যু হবে না। পৃথিবীতে সাধারণ আগুনের বৈশিষ্ট হলো, তা শরীরকে পুড়িয়ে হৃদয়ে পৌঁছার আগেই মানুষের মৃত্যু হয়ে যায়।
পরনিন্দার ভয়াবহতা ও শাস্তি সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, মিরাজের রাতে আমি এমন কিছু মানুষের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম, যাদের নখগুলো ছিলো তামার তৈরি এবং তা দিয়ে তারা অনবরত তাদের মুখমণ্ডল ও বুকে আঁচড় কাটছিলো। আমি বললাম, হে জিবরাইল! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সেসব লোক যারা মানুষের গোশত খেত অর্থাৎ পরনিন্দা করত এবং তাদের মানসম্মানে আঘাত হানতো। আবু দাউদ ৪৮৭৮
পরনিন্দার ভয়াবহতা থেকে বেঁচে থাকার জন্য করণীয় হলো, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কারো দোষ চর্চা না করা। কেউ কারো দোষ চর্চা করলে তাতে অংশগ্রহণ না করা। নিন্দাকারীর কথাকে পাত্তা না দেওয়া। তাকে নিন্দা করতে নিষেধ করা। না শুনলে উক্ত স্থান ত্যাগ করা। তবেই নিজেকে রক্ষা করা যাবে পরনিন্দার পাপ থেকে।
লেখক: ধর্মীয় নিবন্ধকার