চৈনিকরা বিশ্বকে শিখিয়েছিল চা পান করতে, আর মধ্যপ্রাচ্যের বদৌলতে এসেছে কফি। পানি বাদ দিলে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি পান করা হয় এই দুটি পানীয়—কফি আর চা। কফি উৎপন্ন হয় বিশ্বের অন্তত ৫০টি দেশে। ইদানীং বাংলাদেশেও কফি উৎপন্ন হচ্ছে। বিশ্বে প্রতিদিন ২২৫ কোটি কাপ কফি খাওয়া হয়।
কফি গরম এবং ঠান্ডা দুভাবেই খাওয়া যায়। আবার পান করা হয় দুধ মিশিয়ে কিংবা দুধ ছাড়া। কফি হয় বিন থেকে। কফির রয়েছে বিভিন্ন ধরন। আবার পান করা হয় নানাভাবে। তবে পানীয় ছাড়া ডেজার্টেও ব্যবহার করা হয় কফি। তবে আরও প্রণিধানযোগ্য, কফির রয়েছে বিশেষ কিছু গুণ, যা মানুষের স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় সহায়ক।
কার্যকর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
মানুষের শরীরে রয়েছে ক্ষতিকারক ফ্রি র্যাডিক্যালস। এ ধরনের উটকো ঝঞ্ঝাট দূর করতে সিদ্ধহস্ত কফি। এর মধ্যকার রাসায়নিক পদার্থ যা অ্যান্টিঅক্সিডান্ট নামে পরিচিত, ফ্রি র্যাডিক্যালকে শায়েস্তা করে থাকে অনায়াসে। কফির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে কিংবা স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ফলে ডায়াবেটিস কাছে ঘেঁষেতে পারে না।
রোগ প্রতিরোধী ভূমিকা
বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা রয়েছে কফির। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন সক্রিয়, তেমনি ক্যাফেইনও। ফলে বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের জটিল রোগ আক্রমণ করে পারে না।
পারকিনসন্স ডিজিজ
এই বিস্ময় পানীয় অনেক ধরনের জটিল রোগের আক্রমণ থেকেও শরীরকে রক্ষা করে থাকে। এর মধ্যে একটি হলো পারকিনসন্স ডিজিজ। এই রোগ মূলত অকেজো করে ফেলে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ। ফলে শরীর ক্রমেই অশক্ত হয়ে পড়ে। গবেষণা বলছে, পারকিনসন্সের প্রাথমিক উপসর্গ দূর করতে বিশেষ কার্যকর ক্যাফেইন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কফি মস্কিষ্ককে এই রোগের আক্রমণ প্রতিহত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আলঝেইমারস ডিজিজ
মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ বা নিউরোনকে আক্রমণ করে আলঝেইমারস ডিজিজে। ফলে স্মৃতিভ্রংশ হয় মানুষ। এমনকি ভাবনার প্যাটার্ন আর আচরণও বদলে যেতে থাকে। কফির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এ ক্ষেত্রে বর্ম হিসেবে কাজ করে। এমনকি যেসব প্রোটিনের কারণে এই রোগ হয়, সেগুলোকে বিনষ্ট করে।
স্ট্রোক
মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেলে মূলত স্ট্রোক হয়ে থাকে। ফলে দিনে অন্তত এক কাপ কফি পান এই আশঙ্কা কমায়। কফি মস্তিষ্কের প্রদাহ কমানোর পাশাপাশি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে কালো কফি রক্তচাপ হ্রাস করে, যা পরোক্ষে স্ট্রোকের আশঙ্কা দূর করে।
যকৃৎ
শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ হলো যকৃৎ। এর সুস্থতায় বিশেষ ভূমিকা রাখে কফি। প্রতিদিন অন্তত তিন কাপ কফি যকৃতের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, সিরোসিস আর ক্যানসার থেকে রক্ষা করে। এমনকি এ ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিকল্প ওষুধ হতে পারে কফি। কফিতে রয়েছে নানা ধরনের অন্তত শতাধিক রাসায়নিক যৌগ। বিজ্ঞানীরা এসব যৌগের বৈশিষ্ট্য আর কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করে যকৃতের চিকিৎসায় কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ক্যানসার
স্তন ও প্রস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধে কফি কার্যকর ভূমিকা রাখে। এমনকি ডিম্বাশয় ও পাকস্থলীর ক্যানসার প্রতিরোধ করে থাকে।
গলস্টোন
গলব্লাডার বা পিত্তথলি মূলত হজম প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এখান থেকেই নিঃসৃত হয় হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড। ছোট্ট এই থলিতে যে পাথর হয়, তা বস্তুত জমাট বাঁধা কোলেস্টেরল স্ফটিক ও গলব্লাডারের অন্যান্য বস্তু। পাথর হলে ব্যথা হতে থাকে। সময়মতো চিকিৎসা না করালে নানা শারীরিক জটিলতারও সৃষ্টি হয়। কফি পিত্তথলিতে কোলেস্টেরলকে জমাট বেঁধে স্ফটিক হতে দেয় না। এতে পাথর হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়।
হৃৎপিণ্ড
এখন যা অবস্থা, তাতে আমরা সবাই ব্যাকুল হৃদয়ের কথা বলতে। দুদিন আগেই গেল বিশ্ব হার্ট দিবস। এতে আরও স্পষ্ট হলো মানুষ তাদের হৃদয় নিয়ে কতটা চিন্তিত। তাই এবার আসা যাক হার্ট প্রসঙ্গে। একসময় ধারণা করা হতো, হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে শত্রুতা আছে কফির। কফিতে থাকা ক্যাফেইন হার্টের ক্ষতি করে থাকে। কিন্তু আধুনিক গবেষণা বলছে, ক্যাফেইন বরং হৃৎপিণ্ডের সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। গবেষণায় প্রকাশ, প্রতিদিন তিন-পাঁচ কাপ কফি পান করলে রক্তনালিতে ক্যালসিয়াম তৈরিতে বাধা সৃষ্টির ফলে হৃৎপিণ্ডের কোষে রক্তের প্রবাহ সচল রাখে। এতে হৃৎপিণ্ডের রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে।
প্রয়োজন পরিমিতির
কফি ক্যাফেইন অবশ্যই শরীরের পক্ষে ভালো। নানা রোগের আক্রমণ প্রতিহত করে। প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তবে অধিক কফি পান না করাই ভালো। কারণ যেকোনো কিছুরই পরিমিতি আবশ্যক। তাতে শরীর সুস্থ থাকে। কফির ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। শরীরে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন অস্থিরতা বাড়ায়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়; এমনকি ক্যালসিয়াম সঞ্চয়ে ব্যাঘাত ঘটিয়ে হাড় দুর্বল আর ভঙ্গুর করে তোলে।
তথ্যসুত্র: ওয়েবএমডিডেইলি